বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে কিংবদন্তী অভিনেত্রীর নাম শাবানা (Shabana)। মাত্র নয় বছর বয়সে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন, দাপটের সাথে অভিনয় চালিয়ে গেছেন দীর্ঘদিন, তারপর হঠাৎ করেই চলচ্চিত্রকেই শুধু বিদায় জানাননি, জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এনে দেশ থেকে বিদায় নিয়ে স্বামী সন্তানসহ প্রবাসী হয়েছেন। বর্তমানে অভিনেত্রী শাবানা সজীব হয়ে আছেন সিনেমার দর্শকদের মনে, ব্যক্তি শাবানা স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছেন।
শাবানার জীবন অনেকটা চলচ্চিত্রের গল্পের মতই। তার বাবার নাম ফয়েজ চৌধুরী, মায়ের নাম ফজিলাতুন্নেসা। বাবা ফয়েজ চৌধুরী পেশায় টাইপিস্ট ছিলেন বলে জানা যায়, আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য তিনি পেশা পরিবর্তন করে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন বলে শোনা যায়। আর্থিক অবস্থার কারণে এবং পড়াশোনায় অনাগ্রহের কারণে শাবানার শিক্ষাও নয় বছর বয়সেই সমাপ্ত হয় বলে জানা যায়। ফয়েজ চৌধুরী তার মেয়েকে নিয়ে এফডিসিতে আসতেন। ১৯৬২ সালে মাত্র নয় বছর বয়সে শাবানা ‘নতুন সুর’ নামের চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। ১৯৬৩ সালে তালাশ সিনেমার একটি নাচের দৃশ্যে অভিনয় করেন। এর পরে বিভিন্ন ছবিতে অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। ‘আবার বনবাসে রূপবান’ এবং ‘ডাক বাবু’ চলচ্চিত্রে তিনি সহনায়িকার চরিত্রেও অভিনয় করেন। ১৯৬৭ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘চকোরী’ চলচ্চিত্রে চিত্রনায়ক নাদিমের বিপরীতে রত্না থেকে নাম পাল্টে শাবানা হয়ে প্রথম নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেন। চকোরী দারুন ব্যবসা সফল ছবি হ্ওয়ায় শাবানাকে আর ফিরে তাকাতে হয় নি। সে সময় অনেকগুলো উর্দু ছবিতে অভিনয় করেন শাবানা। অবুঝ মন এবং মধু মিলন এই দুটো ছবিতে অভিনয় করার মাধ্যমে তিনি রাজ্জাকের জুটি বাধেন এবং একের পর এক জনপ্রিয় ছবি উপহার দিয়ে যান। প্রায় একই সময়ে তিনি তার বাবার সাথে মিলে চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা গড়ে তোলেন। এই প্রযোজনা সংস্থা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্রের নাম ‘মুক্তি’ যার পরিচালক ছিলেন শাবানার বাবা ফয়েজ চৌধুরী।
এরপর আলমগীরের সাথে তার দীর্ঘস্থায়ী জুটি গড়ে ওঠে। জুটি হিসেবে তাদের ছবির সংখ্যা এক শতাধিক। শাবানা-আলমগীর জুটির প্রথম ছবি দস্যুরানী। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় সিরাজুল ইসলাম ভুঁইয়া পরিচালিত ছবিটি। জুটি হিসেবে শাবানা-আলমগীর প্রতিষ্ঠা পান আশির দশকে। ১৯৮৩ সালে মুক্তি পায় এ জে মিন্টুর ‘মান সন্মান’। অবশ্য এর আগে ‘সাম্পানওয়ালা’, ‘মনের মানুষ’, ‘মধুমিতা’, ‘অতিথি’ ও ‘মনিহার’ হিট হয়। কিন্তু ‘মান সন্মান’ ছিল জুটি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতার চূড়ান্ত পরীক্ষা। আশি দশকের মধ্যবর্তী থেকে নব্বই দশকের শেষ অবধি এ জুটি ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এ জুটির ১০০তম সিনেমা ছিল মনোয়ার খোকন পরিচালিত ‘সংসারের সুখ-দুঃখ’। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে। তাদের শেষ ছবি ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’, মুক্তি পায় ২০০০ সালে। যার পরিচালক আজিজুর রহমান। এটি শুধু জুটি হিসেবেই নয় শাবানার মুক্তি পাওয়া শেষ ছবিও।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের শুরুর দিকে চিত্রনায়ক নাদিমকে ঘিরে কিছু গুজব শোনা গেলেও শাবানা সেগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। ১৯৭৩ সালে সরকারী কর্মকর্তা ওয়াহিদ সাদিকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শাবানা। শাবানার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এস এস প্রোডাকশন দেখাশোনার দায়িত্ব নেন ওয়াহিদ সাদিক। শাবানা-সাদিকের সংসারে তিনটি সন্তান – দুই মেয়ে সুমি এবং উর্মি এবং পুত নাহিন।
১৯৯৭ সালে শাবানা হঠাৎ চলচ্চিত্র থেকে বিদায়ের ঘোষনা দেন এবং নতুন ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হওয়া বন্ধ করে দেন। ২০০০ সালে শাবানা সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে বসবাস শুরু করেন এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। জীবন যাত্রায় পরিবর্তন এনে তিনি ধার্মিক জীবন শুরু করেন, ফুলহাতা কামিজ, হিজাব ইত্যাদি পোশাকে সম্পূর্ণ শরীর আবৃত করে রাখা শুরু করেন। অতি সম্প্রতি শাবানা তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো প্রদর্শন না করার ব্যাপারেও অনুরোধ করেন।
প্রায় এক যুগ পরে শাবানা দেশে ফিরেন গত ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। শ্বশুর বাড়ি কেশবপুরের বড়েঙ্গা গ্রামে নিজস্ব বসতবাড়ি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য তিনি দেশে ফিরেন। উল্লেখ্য, শাবানার স্বামী ওয়াহিদ সাদিকের বড় ভাই হলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মরহুম এ এস এইচ কে সাদেক। গ্রামের বাড়িতে ২০ শতক জায়গার উপরে ছাত্রনিবাসসহ একটি আধুনিক মাদ্রাসা নির্মানের কাজ শুরু করেছেন বলে শাবানা জানান। রাজনীতিতে আসবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি নেতিবাচক মতামত প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, স্বামী ওয়াহিদ সাদিক যদি রাজনীতিতে যোগ দেন, তবে সেক্ষেত্রে তার সমর্থন থাকবে।
বেগম রোকেয়া চরিত্রে অভিনয় করা অভিনয় জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিল এমনটি জানিয়েছিলেন শাবানা। সুভাষ দত্ত ছবিটি নির্মানের উদ্যোগ নিয়ে কিছুদূর এগিয়েছিলেন, ১৯৯৫ সালে মহরতও অনুষ্ঠিত হয়। তথ্য মন্ত্রনালয় ছবিটি সমাপ্ত করার উদ্যোগ নিতে পারে – এমনটি জানিয়েছিলেন শাবানা সাংবাদিকদের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে।
শীর্ষস্থানে থাকতেই চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিয়েছিলেন শাবানা। তার সমসাময়িক অভিনেত্রীরা অনেকেই এখনো অভিনয় করলেও তিনি রয়ে গেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। কিন্তু যে শাবানাকে দর্শকরা স্থান দিয়েছে হৃদয়ে, দৃষ্টিসীমানার বাইরে গেলেই কি তাকে ভুলে থাকা যায়? শাবানা বিস্মৃত হন নি, হবেন না কোনদিনও।