মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে আলোড়ন তোলা এক অনন্য অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি (Humayun Faridi)। এই অভিনেতা অসাধারণ সব অভিনয়ের মাধ্যমে সকল শ্রেণীর দর্শকদের কাছে অধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। একটা সময় ছিল যখন টিভি নাটক মানেই ফরীদি। তারপর একটা সময় মানুষ শুধু হুমায়ূন ফরীদির অভিনয় দেখতে হলে যেতেন। বাংলা চলচ্চিত্রে খল নায়কের ভূমিকায় তিনি ছিলেন অসাধারণ।
চলচ্চিত্রে কিভাবে এলেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন – পরিচালক খোকনের সাথে। প্রশ্নকর্তা শুধরে দিলেন, না মানে এফডিসিতে কিভাবে? বেবীটেক্সিতে করে। বাংলা চলচ্চিত্রে খলনায়ককে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, সিনেমায় নায়কের চেয়ে খলনায়কের প্রতিই দর্শকের আকর্ষণ ছিল বেশী।
হুমায়ূন ফরীদির অভিনয় জীবন শুরু মঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নাট্য উৎসবে তিনি অন্যতম সংগঠক ছিলেন। এখানে তিনি ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লিখেন, নির্দেশনা দেন এবং অভিনয় করেন। এ নাটকটি পাঁচটি নাটকের মধ্যে সেরা নির্বাচিত হয় বিচারকদের কাছে। এ নাটকের সুবাদে পরিচয় ঘটে ঢাকা থিয়েটারের নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর সঙ্গে। মূলত এখান থেকে হুমায়ূন ফরীদির অভিনয় যাত্রা শুরু। মূলতঃ এই উৎসবের মাধ্যমেই তিনি নাট্যাঙ্গনে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ঢাকা থিয়েটারের সদস্যপদ লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল-দীনের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
ঢাকা থিয়েটারের মধ্য দিয়ে হুমায়ূন ফরীদির মঞ্চযাত্রা শুরু হয়। তিনি বলেছিলেন, চা আনা আর কস্টিউম পরিয়ে দেয়া পর্যন্ত তার প্রাথমিক গণ্ডি। আর সেলিম আল দীনের ‘চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারি’ নাটকের প্রোডাকশনে কাজ করি। এরপর একই দলের একই লেখক ও নির্দেশকের ‘সংবাদ কার্টুন’-এ ছোট্ট একটি চরিত্রে সুযোগ পাই। তারপর ‘শকুন্তলা’. শকুন্তলার পর ‘ফণীমনসা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’ এবং ১৯৯০ সালে ‘ভূত’ দিয়ে শেষ হয় হুমায়ুন ফরীদির ঢাকা থিয়েটার জীবন। আর এই ভূতের নির্দেশক ছিলেন তিনি নিজে। যে ‘ভূত’ অবলম্বনে পরবর্তীতে শাহরুখ খান-রানী মুখার্জির ‘পহেলী’ নামের একটি ছবিও নির্মিত হয় মুম্বইয়ে। এটি ছিল একটি রাজস্থানি গল্প। মূলত বন্ধু-অভিনেতা আফজাল হোসেনের সাহস এবং উৎসাহে হুমায়ুন ফরীদির টেলিভিশন যাত্রা শুরু হয়। আফজাল হোসেন বন্ধুর কথা ভেবে পর পর অনেক নাটক লেখেন। যদিও টেলিভিশনে অভিষেকটা ঘটে আতিকুল হক চৌধুরীর মাধ্যমে। সেটাও অবশ্য আফজাল হোসেন ও রাইসুল ইসলাম আসাদের সুবাদে। সেলিম আল দীনের রচনা এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নির্দেশনায় ধারাবাহিক নাটক ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ দিয়ে বেশ আলোচনায় আসেন ফরিদী। এখানে তার চরিত্রটি ছিল বয়োজ্যেষ্ঠ সেরাজ তালুকদারের। যা ওই বয়সের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। হুমায়ুন ফরীদি টিভি নাটকে প্রথম অভিনয় করেন আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’-এ। তার অভিনীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘নীল আকাশের সন্ধানে’, ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘বকুলপুর কতদূর’, ‘মহুয়ার মন’, ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘চাঁনমিয়ার নেগেটিভ পজেটিভ’, ‘অযাত্রা’, ‘পাথর সময়’, ‘দুই ভাই’, ‘শীতের পাখি’, ‘সংশপ্তক’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘সমুদ্রে গাঙচিল’, তিনি একজন’, ‘চন্দ্রগ্রস্ত’, ‘কাছের মানুষ’, ‘মোহনা’, ‘বিষকাঁটা’, ‘ভবের হাট’ ও ‘শৃঙ্খল’. প্রথম মঞ্চনাটক কিশোরগঞ্জে মহল্লার নাটকে ১৯৬৪ সালে। প্রথম মঞ্চনাটক নির্দেশনা দেন স্কুল জীবনে রাজস্থানের লোককথা অবলম্বনে ‘ভূত’।
তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র অভিনয় তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি হচ্ছে- ‘ভণ্ড’, ‘সন্ত্রাস’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামলছায়া’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘মায়ের মর্যাদা’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’ ও ‘পালাবি কোথায়’. উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক-‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’, ‘ফণীমনসা’, ‘শকুন্তলা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’ প্রভৃতি। টিভি নাটক অথবা মঞ্চে সেলিম আল দীন এবং নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু জুটির বাইরে হুমায়ুন ফরীদির সর্বাধিক সংখ্যক এবং সর্বাধিক সফল কাজ ছিল হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে। আর ‘সংশপ্তক’ ধারাবাহিকে তার অভিনীত চরিত্র কান কাটা রমজানের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। ১৯৮৫ সালের দিকে হুমায়ুন ফরীদি অনুধাবন করেন তিনি আসলে অভিনয় ছাড়া আর কিছু করতে পারবেন না। অন্য কিছু থেকে রোজগার করে জীবন নির্বাহ করা সম্ভব নয়। তার একমাত্র অবলম্বন কিংবা পুঁজি হচ্ছে অভিনয়। অনেকটা এমন দুর্বলতা থেকেই ’৯০ থেকে শুরু করেন চলচ্চিত্রে যাত্রা। তার ভাষায়, আমার চলচ্চিত্র অভিনয়টাকে যে যাই বলুক না কেন, ওটা না করলে আমি বাঁচতে পারতাম না। চলচ্চিত্রে কাজ না করলে হয়তো যাত্রা দলে ভিড়ে যেতেন তিনি। এমন প্রস্তুতিও ছিল তার মধ্যে। শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘সন্ত্রাস’ ছবির মাধ্যমে খলনায়ক চরিত্র শুরু হয় তার। সেই হুমায়ুন ফরীদি ২০০৩ সাল থেকে সিনেমাতে অভিনয় প্রায়ই ছেড়ে দিয়েছিলনে।
স্বাধীনতার পর রমনায় প্রথম স্ত্রী মিনু ওরফে নাজমুন আরা বেগমের সাথে বেলী ফুলের মালা বদল করে বিয়ে করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। সে মালা ছিড়ে বিয়ে করেছিলেন সুবর্ণা মোস্তফাকে। মিনু ছিলেন সহপাঠীর বোন। হুমায়ূন ফরীদি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, শুধু সহপাঠীর বোনই নন, তিনি প্রথমত প্রেমিকা, দ্বিতীয়ত ছিলেন স্ত্রী। মিনু আমার জীবনে না এলে হয়তো বোহেমিয়ান জীবন থেকে ফিরে আসা হতো না। হতে পারতাম না আজকের ফরীদি। জীবনের শেষ অংকে এসে ২০০৮ সালে স্ত্রী সুবর্ণ মুস্তাফার সাথেও ছাড়াছাড়ি হয়। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে একটি সন্তান রয়েছে, তার নাম সাররাত ইসলাম দেবযানী।
১৯৫২ সালের ২৯শে মে ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে ঢাকার নারিন্দায় জন্মেছিলেন তিনি। জন্ম ঢাকায় হলেও শৈশব-কৈশোরে স্থায়ীভাবে তার থাকা হয়নি ঢাকায়। বাবার চাকরির সুবাদে ঘুরতে হয়েছে মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুরসহ আরও অসংখ্য জেলায়। বাবা এটিএম নুরুল ইসলাম ছিলেন জুটবোর্ডের কর্মকর্তা। মা বেগম ফরিদা ইসলাম গৃহিণী। হুমায়ূন ফরীদির ডাকনাম পাগলা, সম্রাট, গৌতম প্রভৃতি। দুই ভাই দুই বোন। জাহাঙ্গীরনগরে অর্থনীতি বিষয়ে শিক্ষাজীবন শেষ হলেও প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেছেন বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন স্কুলে। যেমন, প্রাথমিক স্কুল কালীগঞ্জ, হাইস্কুল মাদারীপুর আর চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি। এসএসসি শেষ করেন ১৯৬৮ সালে। এইচএসসি শেষ হয় ’৭০ সালে। একই বছর জৈব রসায়নে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর যুদ্ধ-অস্থিরতা। শুরু হয় টানা পাঁচ বছরের বোহেমিয়ান জীবন। বোহেমিয়ান জীবনকে শৃঙ্খলায় এনেছিলেন প্রেমিকা এবং প্রথম স্ত্রী মিনু। পরবর্তীতে ফরীদি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১২ তারিখে এই অভিনেতা মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময়ে তিনি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছিলেন। সকাল ১০টার দিকে ধানমন্ডিতে নিজের বাসায় বাথরুমে পড়ে গিয়ে তিনি মারা যান। ধানমন্ডির মডার্ন হাসপাতালে চিকিৎসকরা জানান, তিনি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না করা এবং কম ঘুমানোর কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তার দেহের ওজন কমে যায়। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রাও হ্রাস পায়। এ কারণে তাকে কয়েক ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। পরে তাকে বিশ্রামে থাকতে এবং নিজের শরীরের প্রতি আরো যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।