আনোয়ার হোসেন

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রশিল্পী, চিত্রগ্রাহক এবং স্থপতি আনোয়ার হোসেন (Anwar Hossain) বাংলাদেশে খুব বেশি সংখ্যক চলচ্চিত্রে চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ না করলেও প্রায় সকল চলচ্চিত্রের জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছেন এবং পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন। সূর্য দীঘল বাড়ী চলচ্চিত্রে অসাধারণ চিত্রগ্রহণের জন্য আনোয়ার হোসেনের নাম শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করা হয়।

আনোয়ার হোসেনের বেড়ে উঠার – সাফল্যের গল্প সিনেমাকেও হার মানায়। বর্তমানের তাজমহল সিনেমার ঠিক পেছনে বস্তি এলাকায় শৈশব কাটিয়েছেন তিনি। বেড়ার সারি সারি ঘরের মাঝ দিয়ে সরু গলি, সেই গলি দিয়ে দুটো সাইকেলও পাশাপাশি চলতে পারে না – এমন পরিবেশে থেকে প্রবল ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে নিজেকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে এসেছেন আনোয়ার হোসেন। পড়াশোনার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ ছিল বলে প্রতিদিন ভোর সাড়ে চারটেয় ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতেন তিনি। পড়া শেষ হতে হতে সকাল, তখন আসতো তার পাড়ার বাকী ছেলেরা। তাদের খালি গা, খালি পা, হাতে বস্তা। তাদের সাথে মিলে যেতেন হাটে। ওখানে কাঠ চেরা হতো, সেই কাঠের ছোট টুকরো জড়ো করে বস্তায় ভরতেন। বস্তা প্রতি দাম ছিল আট-ন আনা। এ পরিমাণ রান্নার কাঠ কিনতে গেলে ৩-৪ টাকা পড়ত। সেখান থেকে ফিরে বাজার করে দিয়ে যেতে হতো স্কুলে।

দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে কেটেছে স্কুল জীবন। স্কলারশিপের টাকায় পড়াশোনা করতেন, কিন্তু সময়মত বেতন দিতে না পারার কারণে প্রায়ই রোলকলের সময় তার নাম ডাকা হত না, অথচ তিনি ফার্স্ট বয়। স্কুলড্রেস নিয়ে সমস্যায় পড়তে হত। সন্ধ্যার পর এক হারিকেনের আলোয় পড়তেন তিনি এবং তার বন্ধুরা। কিন্তু কোন এক পরীক্ষায় লেখা রচনার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন স্কুলের এক শিক্ষক, জড়িয়ে ধরেছিলেন বুকে। সম্ভভত সেই প্রথম আনোয়ার হোসেনের সৃজনশীলতার প্রকাশে প্রথম সংবর্ধনা।

আনোয়ার হোসেনের বাবা চাকরী করতেন সিনেমায়, সেই সুবাদে তাজমহল, শাবিস্তান ইত্যাদি সিনেমাহলে বিনেপয়সায় সিনেমা দেখার সুযোগ পেয়েছেন। আর সহজে সিনেমার পোস্টার দেখার সুযোগ, যা দিয়ে তাদের বেড়ার ঘরের ছিদ্র বন্ধ করা হত। নান্দনিক পোস্টার দেখে অভ্যস্ত আনোয়ার হোসেন চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন, শিশু কলাভবনে ভর্তি হয়েছিলেন।  কিন্তু উৎসাহ অনুপ্রেরণার অভাবে বেশীদূর চালানো সম্ভব হয় নি। বরং পড়াশোনায় মনযোগ দিয়েছেন, এসএসসি-তে ফিফত স্ট্যান্ড করে নটরডেম কলেজে ভর্তি হলেন।

কলেজে স্কলারশিপের টাকা থেকে ত্রিশ টাকা দিয়ে বন্ধুর কাছ থেকে কিনলেন ‘আগফা ক্লাক’ ক্যামেরা, ছবি তোলার শখ পূরন শুরু করলেন ছবি তুলে। কলেজ শেষ করে বুয়েটে স্থাপত্যবিদ্যায় ভর্তি হলেন, তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত ক্লাসে প্রথম হয়েছেন। কিন্তু ছবি তোলার নেশায় পড়াশোনায় ভাটা পড়ল, ১৯৭৪ সালে হঠাৎ একদিন ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে স্কলারশিপ নিয়ে ডিপ্লোমা পড়তে চলে গেলেন।

ডিপ্লোমা শেষ করে দেশে ফিরে সূর্য দীঘল বাড়ী এবং এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী চলচ্চিত্রের কাজ করেন। সূর্য দীঘল বাড়ী চলচ্চিত্রের জন্য সারা বিশ্বে প্রশংসার বাণী কুড়াতে সক্ষম হন। কিন্তু এই যাত্রাটা খুব স্বস্তিদায়ক ছিল না। অনেকটা অভিমানেই ১৯৯৩ সালে দেশ থেকে চলে যান, স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকতে শুরু করেন ফ্রান্সে।

সূর্য দীঘল বাড়ী নির্মানের সময়ই অভিনেত্রী ডলি আনোয়ারের সাথে পরিচয়, প্রেম এবং ১৯৭৯ সালে বিয়ে। ১৯৯১ সালে অজানা কারণে ডলি আনোয়ার আত্মহত্যা করেন। আনোয়ার হোসেনের স্বেচ্ছা নির্বাসনের পেছনে এই আত্মহত্যার ঘটনার শোক কারণ হিসেবে মনে করেন অনেকে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর বছর পাঁচেক ঘুরে বেড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড। ১৯৯৬ সালে ফ্রান্সের মেয়ে মরিয়ামকে বিয়ে করেন। দুটি সন্তান তার – আকাশ ও মেঘদূত।

২০১৮ সালের ১লা ডিসেম্বর তিনি ঢাকার পান্থপথের আবাসিক হোটেল ওলিও ড্রিম হেভেনের কক্ষ থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি।

 

ব্যক্তিগত তথ্যাবলি

পুরো নাম আনোয়ার হোসেন
জন্ম তারিখ অক্টোবর ৬, ১৯৪৮
মৃত্যু তারিখ ডিসেম্বর ১, ২০১৮
জন্মস্থান আগানবাব দেউড়ি, পুরান ঢাকা
স্বামী/স্ত্রী ডলি আনোয়ার

পুরষ্কার

পুরষ্কার বছর ফলাফল বিভাগ/গ্রহীতা চলচ্চিত্র
জয়ী শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক সূর্য দীঘল বাড়ী