ফোক ফ্যান্টাসি আর অ্যাকশন ধারার ছবির অপ্রতিদ্বন্দ্বী ড্যাশিং হিরো ওয়াসিম। বর্তমানে চলচ্চিত্র থেকে দূরে অবস্থান করলেও চলচ্চিত্রের দর্শকমাত্রই তাকে এক নামে চিনেন। নতুন কোন ছবিতে অভিনয় না করলেও তার অভিনীত ছবি এখনো দর্শককে মুগ্ধ করে মন্ত্রের মত – ড্যাশিং হিরো হতে উৎসাহিত করে। একসময় এই হিরোর নামেই সিনেমাহল উপচে পড়ত, বক্স অফিস পরিপূর্ণ হয়ে উঠত। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করে নিজেকে কিংবদন্তী অভিনেতার সারিতে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন অভিনেতা ওয়াসিম।
প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক এস এম শফির হাত ধরে চলচ্চিত্র জগতে অভিষেক ঘটে ওয়াসিমের। ১৯৭২ সালে শফি পরিচালিত ‘ছন্দ হারিয়ে গেলো‘ চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক হন তিনি। এতে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেন। ১৯৭৪ সালে আরেক প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা মোহসিন পরিচালিত ‘রাতের পর দিন‘ চলচ্চিত্রে প্রথম নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ তার। চলচ্চিত্রটির অসামান্য সাফল্যে রাতারাতি সুপারস্টার বনে যান তিনি।
১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ঢাকার চলচ্চিত্রে ওয়াসিম ছিলেন শীর্ষ নায়কদের একজন। সাহসী নায়ক বলা হতো তাকে। আবার কেউবা বলত—ওয়াসিম মানে বাহাদুর নায়ক। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ওয়াসিমের তখন একচেটিয়া রাজত্ব। পোশাকি, সামাজিক, গ্রামীণ, লাভস্টোরি, মারদাঙ্গা সব ধরনের ছবিতেই তার নাম। পর্দায় ওয়াসিম যখন ঘোড়া চালিয়ে আসতেন তখন ছবিঘর করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠত। তার নাম দিয়ে ছিল তখন উল্লাস।
ওয়াসিম দেড়শ’র মতো ছবিতে নায়ক ছিলেন। হাতেগোনা অল্প কিছু ছবি ছাড়া প্রতিটি ছবিই সুপারহিট হয়েছিল। ‘দি রেইন’ তাকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সেদিন। পৃথিবীর ৪৬টি দেশে ‘দি রেইন’ মুক্তি পেয়েছিল। ছবিতে ওয়াসিমের নায়িকা অলিভিয়া। পরবর্তী সময়ে ওয়াসিম-অলিভিয়া জুটি বেঁধে বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন। ‘বাহাদুর’ এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া লুটেরা, লাল মেম সাহেব, বেদ্বীন প্রভৃতিও সফল হয়েছিল। শাবানা, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষ, সুজাতা প্রমুখের বিপরীতেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। তবে শাবানা আর অলিভিয়ার সঙ্গে ওয়াসিম যেসব ছবিতে অভিনয় করেছেন তার প্রতিটিই ব্যবসাসফল হয়েছিল। ‘রাজ দুলারী’তে ওয়াসিম ও শাবানার অভিনয় সেদিন দর্শকদের দারুণ মুগ্ধ করেছিল। ছবিতে তাদের মুখের গানগুলো ছিল দর্শকের মুখে মুখে ফেরে।
১৯৭৯ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার নাম বাদ দিয়ে অন্যান্য সবার নাম ঘোষনা করে পুরস্কার দেয়া হয়। ওয়াসিম মনে করেন ‘ঈমান’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রে তাকে বাদ দেয়া হয়।
ওয়াসিম চলচ্চিত্র প্রযোজনায়ও নাম লিখিয়েছিলেন। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ডব্লিউ আর প্রোডাকশন। তার প্রযোজিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে হিসাব চাই, মোহন বাঁশী, নয়া তুফান ইত্যাদি। তবে প্রযোজক হিসেবে ওয়াসিম খুব সফল হতে পারেন নি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ওয়াসিম চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নেন। পরবর্তীতে আবার চলচ্চিত্রে ফেরার চেষ্টা করলেও বেশিদিন অভিনয় করেন নি। তিনি সর্বশেষ ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান মোঃ আওয়াল পরিচালিত ‘আমার রত্নগর্ভা মা’ এবং জীবন রহমান পরিচালিত ‘কাঁকন দাসী’ ছবিতে। বর্তমানে ধর্মকর্ম আর পরিবার নিয়েই তিনি ব্যস্ত আছেন।
ওয়াসিম বিয়ে করেছিলেন চিত্রনায়িকা রোজীর ছোট বোনকে। তাদের সংসারে দুটি সন্তান – পুত্র দেওয়ান ফারদিন এবং কন্যা বুশরা আহমেদ। ২০০০ সালে তার স্ত্রীর অকালমৃত্যু ঘটে। ২০০৬ সালে ওয়াসিমের কন্যা বুশরা আহমেদ ক্লাস চৌদ্দ বছর বয়সে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। পরীক্ষা চলাকালীন নকলের অভিযোগ তার পরিবারকে জানাবার প্রাক্কালে বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে বুশরা লাফ দেন। অন্যদিকে পুত্র ফারদিন লন্ডনের কারডিফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে এখন ব্যারিস্টার হিসেবে আইন পেশায় নিয়োজিত।
ওয়াসিম পড়াশোনায় ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজের ছাত্রাবস্থায় তিনি বডি বিল্ডার হিসেবে নাম করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি বডি বিল্ডিং এর জন্য ইস্ট পাকিস্তান খেতাব অর্জন করেছিলেন।
তিনি ২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২ টার দিকে রাজধানীর শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।