আলমগীর কবির

বাংলাদেশের মেধাবী নির্মাতাদের অনেকে এখনও বাণিজ্যিক ও শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রের মুশকিল থেকে বের হতে পারেননি। যেটাকে তারা জীবনঘনিষ্ঠ ও শিল্পসম্মত বলে থাকেন, তা জনপরিসরে তেমন একটা সমাদর লাভ করেনি। বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে জীবনঘনিষ্ঠতা বলতে কী বোঝায় তা গত চল্লিশ বছরে অব্যক্তই রয়ে গেছে। এসব দেখে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, চলচ্চিত্রে জীবনঘনিষ্ঠতা বলতে আসলে কী বোঝায়। এই দোলাচলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অবস্থা না ঘরকা না ঘাটকা। কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শুরু থেকে এই বিভাজন এত মোটা দাগে ছিল না।

সালাউদ্দিন, মহীউদ্দিন, জহির রায়হান ও খান আতাউর রহমানের সিলসিলা ধরে সে ধারার একজন আলমগীর কবির। আলমগীর কবির একই সঙ্গে স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্য ও বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাণে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি শিল্প সমালোচনা ও চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম পথপ্রদর্শকও। তার মাঝে শিল্প ও নান্দনিকতার পাশাপাশি বাণিজ্যিক আকাঙ্ক্ষাও প্রবল ছিল। এর একটি দিক হলো, তিনি সিনেমা হলে প্রদর্শনের জন্য সিনেমা বানিয়েছেন। সুইডিশ নির্মাতা ইঙ্গমার বার্গমানের দ্য সেভেনর্থ সিল (১৯৫৭) মুগ্ধ হয়ে বার কয়েক দেখেছিলেন। তখনই তার মধ্যে চলচ্চিত্র তৈরির বাসনা তৈরি হয়। আমরা এই লেখায় আলমগীর কবিরের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন ও চলচ্চিত্র সম্পর্কে সংক্ষেপে পরিচিত হবো।

আলমগীর কবিরের জন্ম ১৯৩৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাঙামাটি শহরে। বাবা আবু সাইয়েদ আহমেদ ও মা আমিরুন্নেসা বেগম। আদি বাড়ি বরিশাল জেলার বানারীপাড়া। লেখাপড়া শুরু করেন হুগলি কলেজিয়েট স্কুলে। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় অনার্স পাস করেন। অনার্স পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই ১৯৫৭ সালের শেষদিকে লন্ডন চলে যান এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকসে বিএসসি ডিগ্রি নেন।

১৯৫৯ সালে লন্ডনে থাকাকালেই তিনি ডেইলি ওয়ার্কার নামের বামপন্থী দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৬২-৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে চলচ্চিত্রের ইতিহাস, নন্দনকলা ও নির্মাণকৌশল বিষয়ে বেশ কয়েকটি কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৬ সালে দেশে ফিরে ইংরেজি পত্রিকা দ্য অবজারভারে, পরে সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে হলিডে ছেড়ে এক্সপ্রেস নামে একটি ট্যাবলয়েড সাপ্তাহিকে জহির রায়হানের সঙ্গে সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। শিগগিরই ঝরঝরে ইংরেজি, দ্রুত এবং সাবলীল রিপোর্টিংয়ে সবার নজর কাড়েন। কঠোর ও বিশ্লেষণধর্মী চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে সুপরিচিত হন। মরহুম নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুনের ধারাবাহিক নাটক সিরাজ-উদ-দৌলাকে নিয়ে এক্সপ্রেস ট্যাবলয়েডের হেডলাইন ছিল, দি লংগেস্ট বোরিং অন দ্য স্ক্রিন। সেই প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ আল মামুন এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, সেদিনই বুঝলাম সর্বোচ্চ ভালো কিছুর স্বার্থে মননশীল সমালোচনা কতটা কাজে আসতে পারে। সীমাবদ্ধতার সঙ্গে কীভাবে যুদ্ধ করতে হয় সেটা শিখেছি আলমগীর কবিরের কাছ থেকে। ষাটের দশকে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি থেকে তিনি সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ পুরস্কার লাভ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ইংরেজি বিভাগের প্রধান হয়ে কাজ করেন। আহমেদ চৌধুরী ছদ্মনামে তিনি ইংরেজি খবর ও কথিকা পাঠ করতেন। একই সময়ে প্রবাসী সরকারের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবেও কাজ করেন। সেই সময় তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে যুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের আবহে তার শুরুটাই ছিল অসাধারণ অনুপ্রেরণাময়। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে জহির রয়হানের স্টপ জেনোসাইড প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে কাজ করেন। পাশাপাশি নির্মাণ করেন লিবারেশন ফাইটার্স নামের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর সামনা-সামনি যুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে এটি নির্মিত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ গ্রহণের দৃশ্য দেখানোর মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটির সূচনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সাউন্ড ট্র্যাকে ওভারল্যাপ করে এই ছবিতে প্রথম আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের জয় বাংলা শপথ গ্রহণ আর সুর বাজছে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের। এভাবে নিজের আদর্শের পরিচয় তুলে ধরেন।

এই প্রসঙ্গে তার রাজনৈতিক অবস্থানের ইতিহাস টানতে হয়। সেই রেশ তার চলচ্চিত্রগুলোতেও স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। লন্ডন থাকাকালে তিনি ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। লন্ডনে ইস্ট পকিস্তান হাউস, ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট প্রভৃতি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং ক্যাম্পেইন এগেইনস্ট রেসিয়াল ডিসক্রিমিনেশন আন্দোলনে সক্রিয় হন, ডেইলি ওয়ার্কারের জন্য কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সাক্ষাত্কার নেন। তার কাছ থেকে গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি ও কৌশল সম্পর্কে ধারণা নেন। ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তিযুদ্ধে শরিক হন। একই সময়ে তত্কালীন ফরাসি উপনিবেশ আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ফরাসি সরকারের হাতে ধরা পড়ে কয়েক মাস জেলে আটক ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি দেশে ফিরে বাংলাদেশে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এক পর্যায়ে আইয়ুব সরকার তাকে গ্রেফতার করে জেলে রাখে। জেল থেকে বেরিয়েও এক বছর তিনি নজরবন্দি থাকেন। এই প্রসঙ্গে নাট্যকার সাঈদ আহমেদ বলেছিলেন, প্রমাণের অভাবে আলমগীর কবির জেল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু ততদিনে দেশ রক্ষায় স্বাধীনতার আশায়, প্রয়োজনে জীবনের চরম মূল্য দিতে আলমগীর কবির প্রস্তুত।

মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারের তথ্য বিভাগ থেকে তোলা নিউজ রিল ও ফুটেজ ব্যবহার করে তিনি নির্মাণ করেন প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ ডায়েরি নামে প্রামাণ্যচিত্র। অন্য কয়েকটি তথ্যচিত্রের চিত্রনাট্য, ধারাবর্ণনা রচনা করেন ও কণ্ঠ দেন। তার আরও কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হলো কালচার ইন বাংলাদেশ, সুফিয়া—অমূল্য ধন, ভোর হলো দোর খোল, আমরা দুজন, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, মণিকাঞ্চন ও চোরাস্রোত। তার নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হলো—ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), সূর্যকন্যা (১৯৭৬), সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), রূপালী সৈকতে (১৯৭৯), মোহনা (১৯৮২), মহানায়ক (১৯৮৪) ও  পরিণীতা (১৯৮৫)। চলচ্চিত্র বিষয়ে আলমগীর কবির বেশ কয়েকটি বই রচনা করেন—ফিল্ম ইন ইস্ট পাকিস্তান, ফিল্ম ইন বাংলাদেশ, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে ও মোহনা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ‘দিস ওয়াজ রেডিও বাংলাদেশ ১৯৭১’ নামে স্বাধীন বাংলা বেতারে নিজের ভুমিকা নিয়ে লেখা একটি স্মতিচারণ মুলক বই আছে।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ধীরে বহে মেঘনা ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই জহির রায়হান এই চলচ্চিত্রটি নির্মানের পরিকল্পনা করেছিলেন।এই চলচ্চিত্রের পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি এবং জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এটি বৈশিষ্ট্যগতভাবে বাংলাদেশে নির্মিত অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র থেকে একদম আলাদা। এতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ ও ফিকশনের সমন্বয় করেন। মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধযাত্রা, ১৬ ডিসেম্বর ট্রাকভর্তি মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি এবং ঘরে ফেরার দৃশ্যের একই ফুটেজ পরবর্তীকালে তার এক সাগর রক্তের বিনিময়ে নামের প্রামাণ্য চলচ্চিত্রেও দেখা যায়।

১৯৭৬ সালে সূর্যকন্যা ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া এই চলচ্চিত্রের জন্য জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। মিথ ও বাস্তবতার অদ্ভুত মিশেল দিয়ে তৈরি এই চলচ্চিত্র। ব্যক্তি, সমাজ ও ইতিহাসে নারীর অবস্থানের সাহসী ব্যাখ্যা তিনি হাজির করেন এই চলচ্চিত্রে। এই চলচ্চিত্রে তিনি এনিমেশনের ব্যবহার করেন। সামগ্রিক গল্প ভাবনা ও কারিগরির সেই জাদুটা এখনও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অতিক্রম করতে পারেনি। এই চলচ্চিত্র সম্পর্কে ধ্রুপদী পত্রিকায় ফারুক আলমগীর লেখেন, যে বিশাল প্রত্যাশা নিয়ে একটি সৃজননিবিড় চলচ্চিত্র প্রত্যক্ষ করা যায়, সূর্যকন্যা তার সমুদয় দাবি পূরণে অপারগ; এমনটি অনুধাবনের পরেও একটি সত্য ভাষণ থেকে যায় এবং তা হলো চলচ্চিত্র-সংজ্ঞায় এর সম্যক-ব্যবচ্ছেদের ফলে আদ্যন্ত এক প্রত্যয়ের সুর দুর্নিরীক্ষ নয়।

১৯৭৭ সালে সীমানা পেরিয়ে চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এই চলচ্চিত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, ১৯৭০-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংসলীলার প্রায় তিন মাস পর একজোড়া মানব-মানবীকে বরিশালের দক্ষিণের একটি সামুদ্রিক চরে আদিম পরিস্থিতিতে কোনো রকমে বেঁচে থাকতে দেখা গিয়েছিল। ঢাকার তত্কালীন সংবাদপত্রে ঘটনাটির বিবরণ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে ছবিটির ট্রিটমেন্ট ইচ্ছাকৃতভাবে কনট্রিভড। যৌন আকর্ষণ বা ভায়োলেন্স ছাড়াও সমাজের ওপর এবং নিচতলার দুটি মানুষের মধ্যে, শ্রেণীগত পর্যায়ে নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো আন্তরিক সম্পর্ক সম্ভব কিনা এটা পর্যালোচনা করাই এই কার্যত ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল। আমার মতে, এই সম্পর্ক সম্ভব, তবে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী শ্রেণীটি তা সহ্য করতে চাইবে না। ব্যবসায়ী পুঁজির চাপে ছবিটির বক্তব্য এবং গতি কিঞ্চিত ছিন্নভিন্ন। চলচ্চিত্রের জীবনঘনিষ্ঠতা ও বাণিজ্যের বিষয়টা তিনি এভাবেই হিসেব করেছেন। এই পর্যালোচনা বর্তমান সময়ের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৭৯ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে রুপালি সৈকতে চলচ্চিত্রের জন্য বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার লাভ করেন। এই চলচ্চিত্র নিয়ে বাংলাদেশ সংবাদের (১৯৭৯) রুপালি সৈকত, প্রত্যাশার মানচিত্র শিরোনামের লেখা শুরু হয় এভাবে—রুপালি সৈকত আলমগীর কবিরের এক আত্ম-আবিষ্কারের ছবি। তিনি উন্মোচন করেছেন আমাদের অতীতকে, একজন মানুষের চেতনাকে। এই আবিষ্কার উন্মোচন আত্ম-জাগৃতির।

১৯৮২ সালে মোহনা চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য রচয়িতার পুরস্কার পান। এটি আন্তজার্তিকভাবে প্রশংসিত হয়। সেই বছর মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে মোহনা চলচ্চিত্রের জন্য ডিপ্লোমা অব মেরিট লাভ করেন। ১৯৮৬ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পরিণীতা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭৮ সালে। ২০১০ সালে তিনি সংস্কৃতি বিভাগে বাংলাদেশে স্বাধীনতা পুরস্কার পান করেন।

আলমগীর কবির ১৯৭১ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যকার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোকে চার ভাগে ভাগ করেন। যুদ্ধের চলচ্চিত্র, গ্রামীণ [ফোক] চলচ্চিত্র, বিকল্পধারা [অফ-বিট] এবং স্বতন্ত্র চলচ্চিত্র। সেই হিসেবে তার ধীরে বহে মেঘনা, সীমানা পেরিয়ে এবং সূর্যকন্যা বিকল্প ধারার মধ্যে পড়ে। কিন্তু এসব চলচ্চিত্রের কাহিনীর বিষয়বস্তু ও নান্দনিকতা জনপরিসরে কৌতূহল উদ্দীপক। দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত ও সম্ভাবনাময়। সেসব সিনেমার অভিনব ভাষাভঙ্গি সাধারণ মানুষের কানে কিছুটা হলেও পৌঁছেছিল। খেয়াল করার বিষয়, আলমগীর কবির সীমানা পেরিয়ে সম্পর্কে বলতে গিয়ে চলচ্চিত্রের সঙ্গে বাণিজ্যের সম্পর্ক খোলাসা করেছেন। বড় ক্যানভাসে তৈরি এই চলচ্চিত্রগুলো বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ হয়নি। সেই অর্থে চার ধরনের চলচ্চিত্রের বিভেদরেখাকে মোটা দাগে দেখলে চলবে না। আজকের দিনে যারা নান্দনিক বিকল্প ধারা থেকে বাণিজ্যিক হয়ে উঠতে চাইছেন তাদের জন্য আলমগীর কবিরের সাফল্য ও ব্যর্থতা দুটোই শিক্ষণীয়। যদি সাধারণ মানুষকেই চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু করা হয়, সেটা যেন নির্দিষ্ট শ্রেণী ও ঘরানার জন্য না হয়। এটা কোনো ব্যক্তিবিশেষের দোষ বা গুণ নয়, আজকাল বাজেটের কারণেও অনেক চলচ্চিত্র নানাভাবে পিষ্ট হয়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের মুশকিল আসানে আলমগীর কবির এখনও তাত্পর্যপূর্ণ।

চলচ্চিত্র নির্মাণ ও লেখালেখির পাশাপাশি আলমগীর তরুণদের নানাভাবে উজ্জীবিত করেছেন। একটি লেখায় চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াতবলেন, I regularly followed up Alamgir Kabir’s articles published mostly on Weekly Holiday and other newspapers. I met Alamgir Kabir when I got admitted into Dhaka Film Institute as in 1970. There, I enriched myself under the supervision of Alamgir Kabir, Zahir Raihan and others. তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন সফল চলচ্চিত্র আন্দোলনে। তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে এ দেশে শক্তিশালী চলচ্চিত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি পাকিস্তানের একমাত্র চলচ্চিত্র সংগঠন পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। মতানৈক্যের কারণে ১৯৬৯ সালে নিজস্ব উদ্যোগে তিনি গড়ে তোলেন ঢাকা সিনে ক্লাব। একই বছর প্রকাশিত হয় তার চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রথম বই সিনেমা ইন পাকিস্তান এবং তার সম্পাদনায় সিনে জার্নাল সিকোয়েন্সের প্রথম সংখ্যা। সেই বছরই তিনি গড়ে তোলেন ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট নামে এ দেশের প্রথম চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। যুক্ত ছিলেন ‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ’ এর ফিল্ম আপ্রিসিয়েন্স কোর্সের সাথে। ১৯৮১–৮৪ সালে এ কোর্সের ছাত্র ছিলেন মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, মানজারে হাসীন মুরাদ, তারেক মাসুদ, শামীম আখতার, আখতারুজ্জামান প্রমুখ। মুনিরা মোরশেদ মুন্নীর বই ‘চলচ্চিত্র আচার্য আলমগীর কবির‘ বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে মোরশেদুল ইসলাম বলেন, “He had the power to motivate young people in filmmaking. After the Liberation War he taught us how to make films in the modern context and how to use the film language through his films. He was the only filmmaker who could correctly react to the historic events of his time. He had a particularly eager and receptive audience.”

আলমগীর কবির এবং তার কাজ নিয়ে সাক্ষাত্কার, চলচ্চিত্রের ফুটেজ, তার লাইভ ফুটেজ নিয়ে পরিচালক কাওসার চৌধুরী নির্মাণ করেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রতিকূলের যাত্রী। এছাড়া তাকে নিয়ে কিছু বইও রচিত হয়েছে। সেগুলো এখন এক রকম পাওয়াই যায় না। আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্রের মধ্যে সীমানা পেরিয়ে, সূর্যকন্যা এবং মহানায়ক বাজারে ডিভিডি আকারে পাওয়া যায়। তার নামে ঢাকার ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আলমগীর কবির চলচ্চিত্র কেন্দ্র।

১৯৬৮ সালে তিনি বিয়ে করেন মনজুরা বেগমকে। ছাড়াছাড়ির পর অভিনেত্রী জয়শ্রীকে বিয়ে করেন। আলমগীর কবিরের তিন কন্যাসন্তান। ১৯৮৯ সালের ১৯ জানুয়ারি একটি চলচ্চিত্র সংসদের উদ্বোধন ও আবু সাইয়ীদ নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আবর্তন-এর প্রদর্শনীতে বগুড়ায় যান আলমগীর কবির। পরের দিন ২০ জানুয়ারি দুপুরের পর গাড়ি চালিয়ে ঢাকায় রওনা হন। সন্ধ্যায় নগরবাড়ী ঘাটে ফেরিতে ওঠার জন্য পল্টুনের একপাশে অপেক্ষা করছিলেন। একটি ট্রাক ব্রেক ফেল করে তার গাড়িটাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেয়। সেই দুর্ঘটনায় একই গাড়িতে থাকা আরও কয়েকজনসহ মৃত্যুবরণ করেন আলমগীর কবির।

কৃতজ্ঞতা: ওয়াহিদ সুজন

 

ব্যক্তিগত তথ্যাবলি

পুরো নামআলমগীর কবির
জন্ম তারিখডিসেম্বর ২৬, ১৯৩৮
মৃত্যু তারিখজানুয়ারি ২০, ১৯৮৯
জন্মস্থানরাঙামাটি, চট্টগ্রাম।

পুরষ্কার

পুরষ্কারবছরফলাফলবিভাগ/গ্রহীতাচলচ্চিত্র
জয়ীবিশেষ পুরস্কার ধীরে বহে মেঘনা
জয়ীশ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা সীমানা পেরিয়ে