প্রতিবাদী সাহিত্য চর্চা করতে করেতই একসময় চলচ্চিত্রকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন প্রয়াত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। পরবর্তীতে চলচ্চিত্রই তার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে। ১৯৩৫ সালের ৫ আগস্ট (বিভিন্ন জায়গায় তার জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৯ আগস্ট, কিন্তু তার বোন দাবি করেছেন জহির রায়হানের জন্ম তারিখ ৫ আগস্ট) তৎকালীন নোয়াখালি জেলার ফেনী মহকুমার অর্ন্তগত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
স্কুল জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেও পরের বছর অর্থনীতি ছেড়ে বাংলায় ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ সালে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। যদিও পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে চলচ্চিত্রের প্রতি বেশি ঝোঁক ছিলো জহির রায়হানের। এ সময়ই সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি প্রবাহ (সম্পাদক), এক্সপ্রেস (কার্যকরী সম্পাদক), খাপছাড়া, যাত্রিক (সহকারী সম্পাদক), সিনেমা, সমকাল, চিত্রালী, সচিত্র সন্ধানী ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়, ১৯৬০ সালে তার প্রথম উপন্যাস শেষ বিকেলের মেয়ে প্রকাশিত হয়।
তবে চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে, ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি যে নদী মরুপথেতেও সহকারি হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাকে এ দেশ তোমার আমার এ কাজ করার আমন্ত্রণ জানান; জহির এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন।
১৯৬১ সালে ‘কখনো আসেনি’ ছবির মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তারপর ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন। পরের বছরই তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ মুক্তি দেন। জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়’র বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।
জহির রায়হান ১৯৬১ সালে নায়িকা সুমিতাদেবীর সাথে পরিণয়সূত্রে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দু’সন্তান বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে তিনি নায়িকা সুচন্দাকে বিয়ে করেন। এ পরিবারেও তার দু সন্তান – অপু রায়হান ও তপু রায়হান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় আসেন জহির রায়হান। তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মীরপুরে যান । কিন্তু সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি।
পাঁচ ভাই ও তিন বোনের পরিবারের একজন জহির রায়হান
লেখা: দেওয়ান পারভেজ, বাংলামেইল২৪ (ঈষৎ পরিবর্তিত)
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত