বাংলা চলচ্চিত্রে গ্রামীন চরিত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক মিয়াভাই নামে পরিচিত অভিনেতার নাম ফারুক (Faruk)। ১৯৭১ সালে এইচ আকবর পরিচালিত জলছবি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন ফারুক। উল্লেখ্য, অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান এই ছবির মাধ্যমে প্রথমবারের মত চিত্রনাট্য লিখেন।
ফারুক চলচ্চিত্রে আসেন ঘটনাচক্রে। স্কুল বয়সেই তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয়দফা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন এবং এ কারণে তার নামে প্রায় ৩৭টি মামলা দাযের করা হয়। এসকল মামলা থেকে বেঁচে থাকার জন্যই বন্ধুদের পরামর্শে তিনি চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হবার চেষ্টা করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এইচ আকবার তার পরিচালনায় ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে তাকে নায়ক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ করেন। প্রথম ছবিতে অভিনয়ের জন্য ফারুক ৫০০ টাকা সম্মানী পেয়েছিলেন।
প্রথম ছবিতেই ফারুকের মধ্যে প্রতিবাদী চরিত্রের ছায়া খুঁজে পান খান আতাউর রহমান, আবদুল্লাহ আল মামুন, নারায়ণ ঘোষ মিতা এবং আমজাদ হোসেনের মতো বিখ্যাত পরিচালকরা। তাদের পরিচালিত ছবিগুলোর প্রধান নায়ক চরিত্রগুলো চলে যায় ফারুকের দখলে। দিন যত যায় বিখ্যাত পরিচালকদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কবরী, শাবানা, ববিতা, রোজিনা, অঞ্জনা, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষ, চম্পা, রানী সহ ৭০-৮০ দশকের প্রায় সব নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করলেও জুটি হিসেবে ববিতা-ফারুক ছিল দর্শকদের সবচেয়ে পছন্দের।
১৯৭৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের পর প্রথম বছরেই লাঠিয়াল চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেতা ক্যাটাগরীতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ফারুক। কিন্তু পরবর্তীতে নয়নমনি, সারেং বউ, গোলাপী এখন ট্রেনে প্রভৃতি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কারণে প্রশংসিত হলেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান নি। ফারুক অবশ্য এ জন্য তার রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রধাণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত এক সাক্ষাতকারে ফারুক বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ের বিভিন্ন ত্রুটি চিহ্নিত করে তিনি বলেন, আমাদের পরিচালনার জন্য যে মনন ও মেধা দরকার আমাদের ঢাকার বর্তমান চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে অনেকেরই সে মেধা নেই। তারা ছবির ওপর পড়াশোনা না করেই প্রযোজক হাতিয়ে নিয়ে নেমে পড়েন সিনেমা তৈরি করতে। তারা ক্যামেরা, লেন্স, সিকোয়েন্স না বুঝেই যখন তখন যে কোনো স্পটে শুটিং শুরু করে দেন। এছাড়া তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর কাহিনী এবং নির্মান শৈলী প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি নতুন নির্মাতাদের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ছবি পরিচালনার জন্য আপনাকে ব্যাপক পড়াশোনা করতে হবে। বিদেশে নয়, দেশেও আপনি এ বিষয়ের ওপর ডিগ্রি অর্জন করতে পারেন। ডিগ্রি ছাড়া, অভিজ্ঞতা ছাড়া আপনি কাজে সফলতা আনতে পারবেন না। স্বাক্ষর রেখে যেতে চাইলে আপনাকে আগে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই।
চলচ্চিত্র অভিনেতা থেকে চলচ্চিত্র প্রদর্শক এবং প্রযোজক হলেও বর্তমানে ফারুক চলচ্চিত্র অভিনয় থেকে দূরে আছেন। চলচ্চিত্রের গল্পের দৈন্যতা এবং অন্যান্য দুরাবস্থাকে এজন্য দায়ী করেন তিনি। ঘোড়াশালে তার মালিকানাধীন প্রেক্ষাগৃহ ‘জলসা’ লোকসানের সম্মুখীন হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে কালিয়াকৈরে তার টেক্সটাইল মিলের আয়ের উপর নির্ভর করে তিনি জীবন যাপন করছেন।
বর্তমানে ফারুক আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (উত্তর) এ মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে আগ্রহী তিনি। তবে শারীরিক ভাবে অসুস্থ ফারুক শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে সফল হতে পারবেন কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে দীর্ঘ একমাস চিকিৎসাধীন ছিলেন ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে।
পারিবারিক জীবনে বিবাহিত ফারুকের স্ত্রী ফারহানা পাঠানের গর্ভে দুটি সন্তান। কন্যা ফারিহা তাবাসসুম পাঠান এ লেভেল পড়াশোনা শেষ করেছেন এবং পুত্র রওশন হোসেন পাঠান এ লেভেলে পড়ছেন।
ফারুক স্বপ্ন দেখেন চলচ্চিত্রে সোনালী দিন ফিরে আসবে আবারও, মুক্তিযুদ্ধের মত প্রয়োজনে চলচ্চিত্রের জন্য যুদ্ধ করতেও আগ্রহী তিনি। ‘মিয়া ভাই’ ডাক তার জীবনের পরম পাওয়া হিসেবে অভিহিত করে ফারুক বলেন – সবসময় তিনি সবার কাছে মিয়া ভাই হয়েই থাকতে চান।