শওকত আকবর

এইতো জীবন, আলোর পিপাসা, অভিশাপ, মিলন, সাগর, পুণম কি রাত, ওয়েটিংরুম, জংলী ফুল, অবুঝ মন, মোমের আলো, দিল এক মিশা প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করে স্মরণীয় হয়ে আছেন যে কিংবদন্তি অভিনেতা তার নাম শওকত আকবর (Shawkat Akbar)। ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত শওকত আকবর বাংলা ও উর্দু মিলিয়ে আড়াইশ’ ছবিতে অভিনয় করেন।

শওকত আকবর স্কুলজীবনে বেশ কয়েকটি বছর তিনি হুগলি স্কুলে পড়াশোনা করেন। তার পিতা ছিলেন হুগলির ইসলামিক কলেজের প্রভাষক। স্কুলজীবন থেকেই শওকত আকবরের নেশা হয়ে দাঁড়াল সিনেমা দেখা। প্রমথেশ বড়ুয়া, অমিত বরণ, রবীন মজুমদারের ছবি দেখার জন্য প্রায়ই যেতেন কলকাতায়। ছবি দেখে দেখে তার মনেও ইচ্ছা জাগে একজন অভিনেতা হওয়ার। স্কুলজীবনে তিনি স্টেজে অভিনয় শুরু করে দেন। প্রথম ‘দেবদাস’ নাটকে অভিনয় করেন। তখন তার বয়স ছিল প্রায় ১৫ বছর। সে সময় শওকত আকবর হুগলিতে ছিলেন। ১৯৫০ সালে বর্ধমান জেলায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তত্কালীন পূর্ববাংলার ঢাকায় চলে এলেন। ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৫২ সালে। এর পরের বছর মেডিকেল কলেজে এলএমএফ কোর্সে ভর্তি হন। কিন্তু কী আশ্চর্য যার ডাক্তার হওয়ার কথা, চিকিত্সকের মহত্জীবন ও দায়িত্বের প্রতি যিনি আকৃষ্ট হবেন—তিনি অবশেষে হলেন রুপালি পর্দার অভিনেতা।

১৯৫৭ সালের দিকে শওকত আকবর মেডিকেল কোর্স শেষ না করেই শৌখিন শিল্পী হিসেবে নাট্যজগতে প্রবেশ করেন। শৌখিন শিল্পী হিসেবে জীবনে প্রথম অভিনয়ের হাতে খড়ি হয় ভারতের প্রখ্যাত বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘তাইতো’ নাটকে। এ নাটকে শওকত আকবর সহনায়কের চরিত্রে ছিলেন। শওকত আকবর প্রথম ‘এইতো জীবন’-এ অভিনয় করেন। ছবিটি ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায়। এইতো জীবন ছবিটি রিলিজের আগেই ১৯৬৩ সালে তার অভিনীত—‘তালাশ’ এবং ‘পয়েসে’ ছবি দুটি মুক্তি পায়। এরপর একে একে তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে কয়েকটি হলো—আগুন নিয়ে খেলা, ভাইয়া, আখেরি স্টেশন, জংলী ফুল, ওয়েটিংরুম, দিল এক শিশা, বেরহম, হামদাম, অপরিচিতা, অভিশাপ, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, শরীফে হায়াত, সাতরং, গৌরী, জীবন থেকে নেয়া, বড় বৌ, টাকা আনা পাই, মোমের আলো, চলো মান গায়ে, আলোর পিপাসা, নতুন সুর, মেঘ ভাঙা রোদ, জানাজানি, আপন দুলাল, ইশারা, অবুঝ মন, ফকির মজনু শাহ প্রভৃতি। ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে শওকত আকবর ভবানী ঠাকুরের চরিত্রে স্মরণীয় অভিনয় করেছিলেন।

অভিনয়ের প্রথমদিকে তার অভিনীত উর্দু ছবি ‘তালাশ’, ‘আখেরি স্টেশন’ এবং ‘ভাইয়া’ তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানে রিলিজ হওয়ার কারণে লাহোর, করাচী, মুলতান, পেশোয়ার, মারী, গুজরানওয়ালা, কোয়েটা, শিয়ালকোট, ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি, গিলগিট প্রভৃতি শহরেও তার নাম সিনেমা প্রেমিকদের মুখে মুখে ছিল।

শওকত আকবরের চেহারা নায়কসুলভ থাকা সত্ত্বেও ঢাকার চিত্র পরিচালকরা তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করেননি। তিনি হাতেগোনা কয়েকটি ছবির নায়ক ছিলেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে। সেসব ছবি হলো—দিল এক শিশা, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, পুণম কী রাত, জুগনু, আওর গম নেহি, এইতো জীবন প্রভৃতি। রোমান্টিক নায়ক হিসেবে তিনি সুমিতা দেবী, রোজী, শর্মিলী, রেশমা প্রমুখের বিপরীতেই বেশি ছিলেন। লাহোরে গিয়ে তিনি সোফিয়া রানু, রোজিনা, রুখসানা, শামীম আরা, বাহার প্রমুখ নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘আমি অভিনয়কে বেশি গুরুত্ব দিই বলে নায়ক রোলের চেয়ে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বরাবর পছন্দ করেছি, অর্থাত্ যে ছবিতে অভিনয় করার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। আর এ ধরনের ছবিতেই বেশি অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছি।’

শওকত আকবর মঞ্চে নাটক করাকালীন তার সঙ্গে মঞ্চ অভিনেত্রী মুক্তার সঙ্গে পরিচয় হয়। তারপর দু’জনার মধ্যে মন দেয়া-নেয়া হলো। অবশেষে ১৯৬১ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬২ সালে তাদের প্রথম ছেলে ভূমিষ্ঠ হলো। সেই ছেলের নাম মিল্টন আকবর, তিনি এক সময় লন্ডনের নামকরা ড্রামবাদক ছিলেন।

শওকত আকবর ১৯৯৬ সালে এক অর্থে অভিমান করেই দেশ ছেড়ে লন্ডনে ছেলের কাছে চলে যান। শেষদিকে তাকে ঢাকার ফিল্মের প্রযোজক-পরিচালকরা ঠিকভাবে কাজে লাগাননি। লন্ডনে গিয়েও তিনি অভিনয় ছেড়ে দেননি একদম। বিভিন্ন নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি নাটকও পরিচালনা করেন।

১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করা এই কিংবদন্তী ২০০০ সালের ২৩ জুন লন্ডনে মারা যান। লন্ডনেই মুসলিম কবরস্থানে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।

(লেখক: লিয়াকত হোসেন খোকন। ঈষৎ পরিমার্জিত)

 

উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র

ব্যক্তিগত তথ্যাবলি

পুরো নামসাঈদ আকবর হোসেন
ডাকনামশওকত আকবর
জন্ম তারিখমার্চ ৭, ১৯৩৮
মৃত্যু তারিখজুন ২৩, ২০০০
জন্মস্থানবর্ধমান জেলা, পশ্চিমবঙ্গ।

কর্মপরিধি