কাহিনী সংক্ষেপ
উচ্চবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা ফাহাদ মা-বাবার একমাত্র সন্তান। দুজনেই স্ব স্ব কাজে ব্যস্ত থাকায় ছেলে বেড়ে উঠতে থাকে নিজের মতো করেই একা, নিজস্ব পরিবেশে। একদিন বানর নাচ দেখে সেই বানরওয়ালার পিছু পিছু বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। এক পার্কে গিয়ে পরিচয় নিম্নবিত্ত পরিবারের তারই সমবয়সী আরেক শিশুর সঙ্গে। ধীরে ধীরে রূপ নেয় বন্ধুত্বের। বন্ধুর সঙ্গে ফাহাদ চলে যায় তার বস্তিতে। মাঝেমধ্যে ঘুরে বেড়ায় ট্রেনে করে। বন্ধুর সঙ্গে কাজও করে। অন্যদিকে ফাহাদের মা-বাবা ছেলের খোঁজে সম্ভাব্য সব কিছুই করতে থাকে। বেশ কিছু জীবনবোধের উপলব্ধির পর ফাহাদ তার নিজের বাসায় ফিরে আসে।
“দূরত্ব”
আমাদের সমাজের দুইটা ভিন্ন রুপ আছে,ঠিক যেমন একই মুদ্রার দুইটা আলাদা পিঠ।
মুদ্রার দুইটা পিঠ যেমন খুব কাছে থেকেও একে অপরের থেকে খুব ভিন্ন,ঠিক তেমনি আমাদের সমাজের এ রুপ দুটিও খুব ভিন্ন একে অপরের থেকে।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলামের আরো একটি জাতীয় পুরস্কার জয়ী শিশুতোষ ঘরনার সিনেমা “দূরত্ব”!
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রবাদপুরুষ হুমায়ুন আহমেদের লেখা গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে এ সিনেমাটি।
গল্পটা যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তার নাম পুতুল।
পুতুল সম্ভ্রান্ত ও ধোনী ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান ও জেসমিন রহমানের একমাত্র ছেলে। গুলশাল এলাকায় আছে তাদের বিশাল প্রাসাদতুল্য বাড়ি।
এই বাড়িতে সব কিছুই আছে পুতুলের জন্য। শুধু যেটার অভাব পুতুল অনুভব করে প্রচন্ড আকারে সেটা ওর বাবা-মায়ের সঙ্গ!
কাজের ব্যস্ততায় ওর বাবা-মা ওকে কোন সময়-ই দিতে পারে না। অগত্যা পুতুলের সময় কাটে টিভি দেখে,গেমস খেলে আর গল্পের বই পড়ে। পুতুলের জন্য একটা আয়াও রাখা আছে,সেই মূলত পুতুলের খাওয়া-দাওয়া আর সব কিছুর খেয়াল রাখে।
কিন্তু পুতুল এসব কিছুর মাঝেও অভাব অনুভব করে।
অভাব অনুভব করে ওর বাবার আদরের,মায়ের শাসন-আদরের।
সেই যে সকালে বের হয়ে যায় কাজের জন্য বাবা-মা, তারপরে ফিরে সেই রাতে। ততক্ষণে ঘুমিয়ে যায় পুতুল।
ঘুমানোর আগে পুতুল চাই তার মা তাকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াক,কিন্তু পুতুলের সে ইচ্ছা পূরণ হয় না।
পুতুলের জন্য নিয়মিত খুব ভাল ভাল খাবার রান্না করা হয়,কিন্তু পুতুলকে একা একা-ই খেতে হয়।
পুতুলের সেটা একদমই ভাল লাগে না,সে চাই তার বাবা-মা তার সাথে বসে একসাথে খাবার খাক। একা একা খাবার খাওয়ার অনিচ্ছা-ই, ওকে সুস্বাদু খাবারেও টানে না।
এভাবেই চলছিল পুতুলের চার দেয়ালের মাঝের জীবন।
হঠাত একদিন পুতুল দেখে ওদের বাসার গেটটা খোলা,দারোয়ান চাচাও আসেপাশে নেই। সুযোগ বুঝে পুতুল বেরিয়ে পড়ে বাইরে। দেখার জন্য ওর থেকে লুকানো প্রতিটা ভিন্নজগত।
যেতে যেতে রাস্তায় ওকে আদর করে গুড়ওয়ালা চাচা ওকে পাটালি গুড় উপহার দেয়।
সেই সাধারণ গুড় খায় পুতুল পরম তৃপ্তিতে।
একটা সময়ে পুতুল গিয়ে বসে একটা পার্কে। পার্কে ওর সাথে পরিচয় হয় এক পথশিশুর সাথে,যার নাম অন্তু মিয়া।
অন্তু মিয়ার একটা কুকুর ছানাও আছে।
অন্তুর থেকে পুতুল জানতে পারে অন্তু থাকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে,ওখানেই রাতে ঘুমায় সে।
মাঝেমাঝে ভিক্ষাও করে। অন্তুর বাবা থাকে ময়মনসিংহ স্টেশনে।
অন্তুর সাথে পুতুলের সখ্যতা হয়ে যায়। ওরা দুজনে মজা করতে বেরিয়ে পড়ে।
অন্তু আর পুতুল দুজনে পুকুরে মাছ ধরতে নামে,দুইটা মাছও পায় তারা। তবে নিজের গেঞ্জিটা হারিয়ে ফেলে পুতুল পুকুরে। গেঞ্জি উদ্ধার করতে গিয়ে প্রায় ডুবে যাওয়া থেকে এক মহিলা বাচায় পুতুলকে।
এদিকে পুতুলের বাসায় হইচই পড়ে গেছে পুতুলকে না পেয়ে।
পুতুলের বাবা পুলিশের সহায়তা নিয়ে পুতুলকে খুজতে থাকেন। মাইকিং করা শুরু হয় আশেপাশের এলাকায় পুতুলের বর্ণনা দিয়ে।
নীমতলী থেকে একজন পীর সাহেবকেও নিয়ে আসা হয়,শোনা যায় উনি নাকি কাপড় শুকে নিখোঁজ মানুষের খোজ বলে দিতে পারেন।
ওদিকে অন্তু আর পুতুল ঘুরতে থাকে ঢাকার নানা জায়গা।
অন্তু পুতুলকে জানায় ওর একটা বোন আছে,মরিয়ম নাম। থাকে কমলাপুর রেলস্টেশন এ।
অন্তুর সাথে পুতুল চলে কমলাপুর অন্তুর বোনকে দেখতে।
মরিয়ম মেয়েটাকে পুতুলের অদ্ভুত লাগে,মেয়েটা কথায় কথায় হাসে।
দুপুরের খাবার পুতুল খায় অন্তুদের সাথে,রাস্তার ধারের একটা দোকান থেকে। অল্প কিছু খেয়েই পুতুল না করে আর খেতে।
খাওয়া শেষে ওরা উঠে পড়ে ময়মনসিংহ এর ট্রেনে। ট্রেনে যেতে যেতে পুতুল পরিচিত হয় এক ফেরীওয়ালা লোকের সাথে। ফেরিওয়ালা ম্যাজিক দেখিয়ে, গান গেয়ে,বেড়ালের মারামারি শুনিয়ে দাতের মাজন আর কর্ণ সুন্দর বিক্রি করে।
কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে তার থেকে কখনোই কেউ কিছুই কিনে না।
পুতুলের খুব খারাপ লাগে।
সে অন্তুর কাছে থেকে এক টাকা নিয়ে একটা কর্ণ সুন্দর কিনে লোকটার থেকে। লোকটা খুশি হয়ে আরেকটা কর্ণ সুন্দর ফ্রিতে দেয় পুতুলকে।
আর ওই এক টাকা দিয়ে কিছু বাদাম কিনে খেতে থাকে নিজের মেয়েকে নিয়ে।
ময়মনসিংহ তে অন্তুর বাবা যে বস্তিতে থাকে সেখানে পুতুল যায় অন্তুদের সাথে। পুতুলের ঠান্ডা লাগছে দেখে মরিয়ম তার ছেড়ে সোয়েটারটা দেয় পুতুলকে। প্রথমে নোংরা বলে যে সোয়েটার পুতুল পরতে চায় নি,সেটাই এখন খুব ঠান্ডার প্রয়োজনে পরে নেয় পুতুল। মরিয়মদের ঠান্ডা লাগছে না,জিজ্ঞাসা করায় মরিয়ম বলে ‘গরীবদের ঠান্ডা লাগে না’ এটা নাকি আল্লাহ নিয়ম করে দিছেন।
পুতুল বুঝে না,কেন আল্লাহ দুই ধরণের নিয়ম করে দিছেন।
এদিকে অন্তুর বাবার বস্তিতে মরিয়ম তিন মিশালী খাবার রান্না করে নিজেদের জন্য। পরম তৃপ্তিতে সেটা খেতে খেতে পুতুল দেখে বস্তিরই একজন মহিলা রান্না করতে করতে তার বাচ্চাদের গল্প শুনাচ্ছে।
পুতুলের তখন তার মায়ের অভাবটা আরো বেশী করে মনে পড়ে।
খাওয়ার পরে পুতুল কথায় কথায় জানতে পারে অন্তুদের ইচ্ছা।
অন্তুর খুব ইচ্ছা একদিন ১ হাজার টাকা জমাবে ওরা। তারপর আর এখানে থাকবে না,সে টাকাটা নিয়ে চলে যাবে গ্রামের বাড়িতে;বাবা সেখানে ছোট একটা দোকান দিবে। ধীরে ধীরে ওরা আরো টাকা জমিয়ে হাস-মুরগী আর গরু কিনবে। ওখানেই সুখে বাকিটা জীবন নিজের পরিবারের সাথে কাটিয়ে দিবে।
পুতুল ওদের কথা শুনে, আর আপন মনে কি যেন ভাবে।
রাতে ঢাকার ফিরতি ট্রেনে আবার ঢাকার জন্য রওনা দেয় ওরা।
এদিকে পুতুলের বাবা আর ধৈর্য ধরতে না পেরে পুতুলের নিখোজ সংবাদ পত্রিকাতে দিয়ে দেয়।
এটাও ঘোষণা দেয়, যে তার পুতুলের খোজ দিতে পারবে তাকে সে ২ লক্ষ টাকা পুরস্কার দিবেন।
পুরস্কারের লোভে নানা জায়গা থেকে মিথ্যা ফোন আসতে থাকে।
কেউ কেউ বলে তারা পুতুলকে অপহরণ করেছে,মুক্তিপণ হিসাবে তাদের ২০ লক্ষ টাকা দিতে হবে। পুতুলের বাবা রাজিও হয়ে যায় কালক্ষেপণ না করে।
এদিকে সকাল হয়ে যায়,অন্তু আর মরিয়মের সাথে পুতুল হাটতে হাটতে পুতুলদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়।
মরিয়ম পুতুলদের বাসা দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, পুতুলরা রাজা কিনা! কারণ মরিয়মের ধারণা এত বিশাল বাড়িতে শুধু রাজারাই থাকতে পারে।
পুতুল জিজ্ঞাসা করে ওদের,ওর সাথে ওর বাসায় আসবে কিনা।
ওরা না করে নিজেদের অবস্থান ভেবে।
পুতুল বুঝতে পেরে চলে যায় নিজের বাসায়,যাবার আগে দিয়ে যায় সারারাত ধরে ওর গায়ে জড়িয়ে ওকে গরম রাখা মরিয়মের ছেড়া সোয়েটারটা।
পুতুলকে দেখে পুতুলের বাবা-মা আনন্দে ফেটে পড়েন যেন। পুতুলকে আদর করতে থাকেন অফুরন্ত।
আর অন্তু আর মরিয়ম তখন রাস্তার ধারে কাগজ পুড়িয়ে আগুনে নিজেদের শরীর সেকে গরম করছে। আসলে গরীবদেরও শীত করে।
একটাই পৃথিবীতে বাস করা দুইটা ভিন্ন জগতের গল্প এত সুন্দর করে তুলে ধরার জন্য আমি ধন্যবাদ জানাব গল্পকার হুমায়ুন আহমেদকে।
পরিচালক মোরশেদুল ইসলামের অনন্য পরিচালনা সিনেমাটিকে দিয়েছে এক অন্যমাত্রার প্রাণ।
সিনেমার সকাল কলাকুশলীদের পাশাপাশি বিশেষ করে ধন্যবাদ না জানালেই নয় প্রিয় অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি,সুবর্ণ মুস্তাফা,রাইসুল ইসলাম আজাদ,হাকিম ফেরদৌস,ওয়াহিদা মল্লিক জলিকে তাদের অনন্য অভিনয়ের জন্য।
আর ভুলে যাবার মত নয় ফাহাদ আর অমল যারা যথারীতি পুতুল আর অন্তু চরিত্র চরিত্রায়ন করছে।
ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেডের প্রযোজনা ও পরিবেশনায় নির্মিত এ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জয়ী এ সিনেমাটি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় আমাদের সমাজেই আমরা কত বড় দূরত্ব তৈরী করে রেখেছি মানুষের সাথে মানুষের মাঝে।
অবসরে এ সিনেমাটি দেখার পাশাপাশি অনুরোধ করব নিজের সাধ্যের মাঝে আমাদের সমাজের নিচের মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে। এ একটা কাজেই আমাদের সমাজের মানুষের সাথে মানুষের মাঝের দূরত্ব কমবে আর ধোনী-গরীব না,আমরা মানুষ হিসাবে বাচতে শিখব।
লেখা:তাহমিদ শুভ