বাংলা চলচ্চিত্রে নব্বইয়ের দশকের সাড়া জাগানো নায়িকার নাম পারভিন সুলতানা দিতি (Parvin Sultana Diti)। সে সময় অল্প যে কজন নায়িকা একের পর এক ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন দিতি তাদের অন্যতম। মিষ্টি চেহারার অনিন্দ্যসুন্দর দিতি তার চমৎকার অভিনয়ের মাধ্যমে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র দিয়েই দর্শকের মনে স্থান করে নিয়েছিলেন।
চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী হবার সম্ভাবনা একদমই ছিল না দিতির। বরং সঙ্গীত শিল্পী হবার সম্ভাবনাটুকুই বেশি দেখা গিয়েছিল তার মধ্যে। খুব ছোটবেলায়ই দিতি গানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। শৈশবে শিশু একাডেমী আয়োজিত প্রতিযোগিতায় জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হন। যে কারণে নায়িকা হওয়ারও অনেক আগে তার গায়িকা হওয়ার ইচ্ছা ছিল। বিটিভিতে একদিন গান করার সময় তিনি আল মনসুরের নজরে আসেন। তিনি দিতিকে খুঁজে বের করে মানস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘লাইলি মজনু’ নাটকে কাস্ট করেন। নাটকটি প্রচারের পর দর্শক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। কিন্তু দিতির অভিনয় চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পরিবার থেকে বাধা আসে। বেশ কিছু দিন বিরতি নিয়ে আবারো ফখরুল আবেদীনের প্রযোজনায় ‘ইমিটেশন’ নাটকে তিনি অভিনয় করেন। এর পরই চলচ্চিত্রে কাজ করার ব্যাপারে তার কাছে প্রচুর অফার আসতে থাকে।
১৯৮৪ সালে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমের মাধ্যমে ঢাকাই সিনেমাতে পদার্পণ করেন তিনি। উদয়ন চৌধুরী পরিচালিত ‘ডাক দিয়ে যাই’ ছিল দিতির ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমা। এতে তার নায়ক ছিলেন আফজাল হোসেন। কিন্তু চলচ্চিত্রটির আশি শতাংশ কাজ হলেও শেষ পর্যন্ত এটি আর মুক্তি পায়নি। দিতি অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আমিই ওস্তাদ’, আর পরিচালক ছিলেন আজমল হুদা মিঠু। এ ছবিতে দিতির অনবদ্য অভিনয় দর্শকদের বেশ নজর কাড়ায় আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এরপর দর্শকদের বহু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে গেছেন ঢাকার সিনেমার সোনালি যুগের এ নায়িকা। এরপর ২৮ বছরে প্রায় দুইশ মত ছবিতে অভিনয় করেছেন। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘স্বামী-স্ত্রী’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য এ পুরষ্কার ঘরে তুলেন তিনি। এ ছবিতে দিতি আলমগীরের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের শীর্ষে থাকা অবস্থায় ব্যক্তিগত কারণে হঠাৎ দেশ ত্যাগ করেন দিতি। পরবর্তীতে ফিরে এলেও চলচ্চিত্রে নিয়মিত হতে পারেন নি।বরং অভিনয়ের গণ্ডি অতিক্রম করে পাড়ি দিয়েছেন নাটকে, পরিচালনায়, সঙ্গীত আর বিজ্ঞাপনের মডেলিং-এ। কলকাতার ছবি ‘প্রিয় শত্রু’ সিনেমায় প্রসেনজিতের সঙ্গে অভিনয় করেছেন দিতি। ছবিটির ‘চিঠি কেন আসে না আর দেরি সহে না’ শিরোনামের গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অভিনয়ের পাশাপাশি সঙ্গীতের চর্চাও করতেন দিতি। দুই যুগেরও আগে অনুপম রেকর্ডিং মিডিয়ার ব্যানারে দিতির প্রথম একক অ্যালবাম ‘তোমার ও চোখে’ বাজারে আসে। এরপর মাঝে দু-একটি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করলেও দীর্ঘদিন আর কোনো অ্যালবাম প্রকাশ করেননি তিনি। ২০১১ আবার সালে লেজার ভিশনের ব্যানারে বাজারে আসে তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ফিরে যেন আসি’। এটিও বেশ প্রশংসিত হয়। আর পরিচালনায় অভিষেক ঘটান ছোট পর্দায় নির্মানের মধ্য দিয়ে। তার পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে নাটক ‘ব্রেকিং নিউজ’, টেলিফিল্ম ‘ভ্যালেন্টাইন অতঃপর ভালোবাসা’, ‘একটি পূর্ণাঙ্গ গল্পের সূচনা’ ইত্যাদি। ২০১৪ সালের শেষের দিকে দিতি গুলশানে নিজের একটি শ্যুটিং হাউজ চালু করেন।
দিতি ইডেন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। তিনি প্রথম বিয়ে করেছিলেন ১৯৮৬ সালে। বর চলচ্চিত্রেরই মানুষ সোহেল চৌধুরী। নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রম দিয়ে দিতির সঙ্গে একই সময়ে পা বাড়ান এ জগতে। চলচ্চিত্রে আসার পর প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক এফ কবীর চৌধুরী সোহেল চৌধুরীকে ‘পর্বত’ নামের ছবিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। ওই ছবিতে তার বিপরীতে নায়িকা ছিলেন দিতি। দুজনের অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল। এর পরের বছর ১৯৮৫ সালে আমজাদ হোসেনের ‘হীরামতি’ ছবিতে অভিনয় করেন সোহেল। এই ছবিতেও তার নায়িকা দিতি। এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই প্রেমে পড়েন দুজন। পরবর্তীতে তারা দুজনে বিবাববন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮৭ সালে জন্ম নেন মেয়ে লামিয়া চৌধুরী আর ১৯৮৯ সালে জন্ম নেয় ছেলে দীপ্ত। তবে সোহেল চৌধুরীর সাথে দিতির সংসার স্থায়ী হয় নি, ভেঙ্গে যায়। পরে ১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাত দুটার দিকে সোহেল চৌধুরী খুন হন বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবে। পরবর্তীতে দিতি তার সর্বাধিক চলচ্চিত্রের জুটি ইলিয়াস কাঞ্চনকে বিয়ে করলেও সেই বিয়েও স্থায়ী হয় নি, ডিভোর্সের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে।
২০১৫ সালে হঠাৎ করে দিতি শারীরিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। দেশের একটি বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় মাদ্রাজে গমন করেন দিতি। জানা যায় তার ব্রেইনে বাসা গেড়েছে মরনব্যাধি ক্যান্সার। ২০১৫ সালের ২৯ জুলাই প্রথমবারের মতো দিতির মাথায় সফল অস্ত্রোপচার করা হয়। মাঝখানে কিছুদিন সুস্থ থাকলেও ইনফেকশনের জন্য আবারও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন দিতি। তারপর দ্বিতীয় দফায় তাকে নভেম্বর মাসে চেন্নাই নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আবারও মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু দিতির মেয়ে লামিয়া জানান – ‘ক্যানসার বা টিউমার নয়, রেডিয়েশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মায়ের ‘পারকিনসন’ রোগ হয়েছে। এটি এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে চলে গেছে। মা আসলে মারা যাচ্ছে। এ মুহূর্তে তার বেঁচে থাকার বিষয়টি ডাক্তারদের আয়ত্বের বাইরে।’ দিতি ফিরে আসেন দেশে। যেন দেশের মাটিতেই তিনি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান।
দীর্ঘ রোগভোগের পর ২০ মার্চ ২০১৬ তারিখ বিকাল চারটেয় ইন্তেকাল করেন পারভীন সুলতানা দিতি।