আব্দুল জব্বার

জননন্দিত সঙ্গীতশিল্পী আব্দুল জব্বার চলচ্চিত্র, আধুনিক বাংলা গান, গণসংগীত ইত্যাদি বিভিন্ন ধারার গান গেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে চূড়ান্ত খ্যাতি অর্জন তাকে জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত করে। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী হিসেবে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন।

চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম গান গেয়েছিলেন ১৯৬২ সালে। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পরিচালিত ‘সংগম’ ছবির গানে কণ্ঠ দেন তিনি। ১৯৬৮ সালে ‘এতটুকু আশা’ ছবিতে সত্য সাহার সুরে তার গাওয়া “তুমি কি দেখেছ কভু” গানটি ভীষণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। সে বছর ‘পীচ ঢালা পথ’ ছবিতে রবীন ঘোষের সুরে “পীচ ঢালা এই পথটারে ভালবেসেছি” ও ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’ ছবিতে রাজা হোসেন খানের সুরে “সুচরিতা যেওনাকো, আর কিছুক্ষণ থাকো” এ দুটি গান তাকে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বৌ’ ছবিতে আলম খানের সুরে তার গাওয়া “ও রে নীল দরিয়া” গানটিও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। তার গাওয়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গান হল রুনা লায়লার সাথে “অমন করে যেও না গো তুমি” প্রভৃতি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’-সহ অনেক দেশাত্মবোধক গানের গায়ক হিসেবে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। তার গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ এবং ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান ৩টি ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার আয়োজনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংলা ২০ গানের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।

২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘কোথায় আমার নীল দরিয়া’ শিরোনামে তার প্রথম মৌলিক অ্যালবাম।

সঙ্গীতজীবনে তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এরমধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক (১৯৭৩), একুশে পদক (১৯৮০), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৬), বাচসাস পুরস্কার (২০০৩), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস-আজীবন সম্মাননা (২০১১) ও জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার।

আব্দুল জব্বারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলায়। তার পিতার নাম দখিল উদ্দিন প্রামাণিক এবং মাতার নাম বেগম ফুলজান। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আব্দুল জব্বার ছিলেন কনিষ্ঠতম। ১৯৫৬ সালে তিনি মোহিনীমোহন বিদ্যাপীঠ থেকে মেট্রিক পাশ করেন। তিনি ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

ফেরদৌসী রহমান

ফেরদৌসী রহমান একজন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক। তিনি পল্লীগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক এবং প্লে ব্যাক সব ধরনের গানেই কণ্ঠ দিয়েছেন।

ফেরদৌসীর গানে হাতেখড়ি হয় তার পিতার কাছে। পরবর্তীতে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, ইউসুফ খান কোরেইশী, কাদের জামেরী, গুল মোহাম্মদ খান-দের মত বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞের কাছে গানের তালিম নিয়েছেন

তিনি ১৯৬০’র দশকে অসংখ্য পাকিস্তানি উর্দু চলচ্চিত্রে এবং বাংলা চলচ্চিত্রে নেপথ্য শিল্পী হিসেবে কণ্ঠ দিয়েছেন। তিনি ১৯৬০ সালে ‘আসিয়া’ চলচ্চিত্রে প্রথম নেপথ্য শিল্পী হিসেবে কণ্ঠ দিয়েছেন। এরপর তিনি ‘এ দেশ তোমার আমার’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘সুতরাং’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘অবুঝ মন’, ‘মানুষের মন’-সহ অসংখ্য ছবির গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। ১৯৭৬ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘মেঘের অনেক রং’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনায় জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।

ফেরদৌসীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৮ জুন। তার বিবাহপূর্ব নাম ছিল ফেরদৌসী বেগম। তিনি লোকসঙ্গীত সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদের মেয়ে এবং মুস্তাফা জামান আব্বাসীর বোন। তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। সঙ্গীত ভুবনে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৭৭ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৫ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে সম্মানিত করে। এছাড়াও তার অর্জিত উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে লাহোর চলচ্চিত্র সাংবাদিক পুরস্কার (১৯৬৩), প্রেসিডেন্ট প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পুরস্কার (১৯৬৫), টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৫), নাসিরউদ্দিন গোল্ড মেডেল পুরস্কার, মাহবুবুল্লাহ গোল্ড মেডেল, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পুরস্কার। ২০১৩ সালে তিনি আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ডস আয়োজন হতে পরম্পরা পরিবার পদক লাভ করেন।

হাসমত

একজন তুখোর কৌতুকাভিনেতা হিসেবে সুপরিচিত হাসমতের পুরো নাম হাসমত উল্লা খান। কৌতুকাভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা এই অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও ছিলেন সফল। তিনি বেশ কয়েকটি ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

হাসমত ১৯৩৬ সালে ঢাকার বংশালে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করেন।

ছোটবেলা থেকে তার অভিনয়ের প্রতি প্রচন্ড ঝোঁক ছিল। একসময় তিনি মঞ্চনাটকের সাথে জড়িত হন। বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করেন, তবে তিনি নাটকে কখনই কমেডি চরিত্রে অভিনয় করেননি, সিরিয়াস ধরনের চরিত্রেই অভিনয় করেছেন, এমন কি তিনি ভিলেন হিসেবেও অভিনয় করেছেন তখন।

হাসমত-এর চলচ্চিত্রে আগমন হয় সহকারী পরিচালক হিসেবে। ১৯৬০ সালে উদয়ন চৌধুরী পরিচালিত ‘বিষকন্যা’ (মুক্তিপায়নি) ছবির সহকারী পরিচালক হিসেবে তিনি প্রথম কাজ শুরু করেন, পরবর্তীকালে তিনি নারায়ণ ঘোষ মিতা’র সাথে কাজ করেন। তিনি মিতার ‘চাওয়া পাওয়া’ (১৯৬৭) ছবিতে অভিনেতা ও সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে আগমন করেন।

হাসমত অভিনীত প্রথম ছবি এম এ খলিল পরিচালিত ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পুনম কি রাত’। এরপর তিনি আরো যেসব ছবিতে অভিনয় করেছেন তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য- চাওয়া পাওয়া, এতটুকু আশা, ময়না মতি, জোয়ার ভাটা, নীল আকাশের নীচে, যে আগুনে পুড়ি, মলুয়া, দীপ নিভে নাই, বিনিময়, শেষ পরিচয়, মানুষের মন, অবুঝ মন, বলাকা মন, উৎসর্গ, অঙ্গীকার, রংবাজ, অতিথি, অনন্ত প্রেম, মধুমিতা, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, চোখের জলে, মধুমিলন, হাবা হাসমত, চাবুক, আলোর মিছিল, অবাক পৃথিবী, হাসি কান্না, বধূ মাতা কন্যা, চাবুক, পিঞ্জর, দুইপর্ব, ঢেউয়ের পরে ঢেউ, উপহার, কত যে মিনতি, কাঁচের স্বর্গ, জেহাদ, আলো তুমি আলেয়া, অন্তরালে, আঁধারে আলো, টাকার খেলা, বধূ বিদায়, ভুল যখন ভাঙলো, এখানে আকাশ নীল, হাসি কান্না, নকল মানুষ, আসামী, আসামী হাজির, বারুদ, কথা দিলাম, বাঁধনহারা, নাগরদোলা, ছন্দ হারিয়ে গেল, কুয়াশা, ধন্যিমেয়ে, অপরাধ, সমাধান, সোনা বৌ, বউ হবো ইত্যাদি।

হাসমত শুধু কৌতুক অভিনেতাই ছিলেন না। তিনি একজন সফল চলচ্চিত্র পরিচালকও ছিলেন। হাসমত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘এখানে আকাশ নীল’ ছবিটি পরিচালনার মাধ্যমে। তার পরিচালিত অন্যান্য ছবিগুলো হলো- স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, হাসি কান্না, নকল মানুষ, মধুমতি, বিধান, ন্যায় বিচার, ববি, বউ হবো, প্রভৃতি।

হাসির রাজা হাসমত এক সময় এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে, তাঁর নামে তাঁকে প্রধান চরিত্র করে, ‘হাবা হাসমত’ নামে একটি ছবিও হয়েছিল। সোহরাব আহমেদ পরিচালিত সেই ছবিতে হাসমত নায়িকা কবিতার বিপরীতে নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছেন। সেই থেকে হাসমত-এর নাম কিংবদন্তী হয়ে যায়- ‘হাবা হাসমত’ নামে।

তিনি ২০০৪ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। কৌতুক অভিনেতা হাসমত তার চলচ্চিত্র কর্মের মাধ্যমে, চিরঅম্লান হয়ে থাকবেন।