দরদভরা গলায় বিরহের গানের সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন যে বংশীবাদক সংগীত শিল্পী তার নাম বারী সিদ্দিকী। ‘শুয়াচান পাখি’, ‘আমি একটা জিন্দা লাশ’সহ বহু গানের মাধ্যমে হৃদয়ে হাহাকার তোলায় সিদ্ধহস্ত শিল্পী বারী সিদ্দিকী চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে গানের মাধ্যমে তার প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু হয়।
বংশীবাদক ও সঙ্গীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতমনস্ক একটি পরিবারে বড় হয়ে উঠেন। তার নানা শেখ সাবির একজন সরদবাদক ছিলেন। তার বাবা গানের সাথে জড়িত না থাকলেও গান বাজনা তার পছন্দের ছিলো।
বড় ভাইকে বাঁশি বাজাতে দেখে বাঁশি বাজানোর আগ্রহ তৈরি হয় বারী সিদ্দিকীর মনে। তখন তিনি বয়সে পাঁচ ছয় বছরের ছেলে। তখন নেত্রকোনায় পদ্ধতিগতভাবে বাঁশী শেখার কোন উপায় না থাকায় তিনি মূলত অন্যান্যদের বাঁশি নকল করে বাজাতেন। সাত আট বছর বয়সেই মা জহুর-উন-নিসার কাছে গান শেখা শুরু করেন। পরে তিনি নেত্রকোনা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে পদ্ধতিগতভাবে সঙ্গীত শেখা শুরু করেন। তার সঙ্গীতের ওস্তাদ ছিলেন শ্রী গোপাল দত্ত। সে সময় বড় দুই ভাই এবং রফিক মাহমুদ, বিপুল চৌধুরী, দুলাল দত্তনবীশ, হযরত আলীর কাছ থেকেও গানে সহযোগিতা পেয়েছেন। ছোটবেলায় মূলত সঙ্গীতশিল্পী হবারই স্বপ্ন ছিলো বারী সিদ্দিকীর। তার মা তাকে উচাঙ্গ সঙ্গীত শিখে তা বাঁশিতে ট্রান্সফর্ম করতে বলতেন।
১৯৮০ সালের দিকে ঢাকায় শুদ্ধ সঙ্গীত প্রসারের একটি অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় ওস্তাদ আমিনুর রহমানের কাছে। তিনি বিমানের পাইলট ছিলেন। ভারত বর্ষের বিখ্যাত বংশীবাদক ওস্তাদ পান্না লাল ঘোষের শিষ্য ছিলেন। সেই আমিনুর রহমানের বাড়িতে থেকেই বাঁশিতে তালিম নিতে থাকেন দিনের পর দিন। সেখানে থেকেই তিনি ওস্তাদ তাগাল ব্রাদার্স, পণ্ডিত দেবেন্দ্র মুৎসুদ্দী, ওস্তাদ আয়েফ আলী খান মিনকারীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন বারী সিদ্দিকী।
সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তার বাসায় বারী সিদ্দিকী বাঁশি বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি গানও করেন। গান শুনে মুগ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৯৫ সালে বিটিভির ‘রং-এর বারৈ’ অনুষ্ঠানে প্রথম গান করেন বারী সিদ্দিকী। এর পরপরই হুমায়ূন আহমেদ তাকে দিয়ে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে গান গাওয়ান এবং বাঁশি বাজান। বাঁশিতে ছিল শ্যাম বিচ্ছেদের একটি সুর। কলিটা ছিলো এরকম ‘আস্ট আঙ্গুল বাঁশের বাঁশি/মধ্যে মধ্যে ছ্যাদা/ নাম ধরিয়া ডাকে বাঁশি/ কলংকিনী রাধা/। চলচ্চিত্রের এ গান বারী সিদ্দিকীকে নতুন জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এর পরপরই বাজারে তার দুটি একক অ্যালবাম আসে। একটি ‘দুঃখ রইলো মনে’ এবং অন্যটি ‘অপরাধী হইলেও আমি তোর’। পরে একসময় তিনি সাক্ষাতকারে হুমায়ূন আহমেদের উৎসাহ দেয়ার কথা স্বীকার করেন।
বারী সিদ্দিকী সবসময়ই নিজেকে একজন বংশীবাদক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। গায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পাবার আগে বারী সিদ্দিকী একজন বংশবাদক হিসেবে বাঁশি বাজিয়েছেন দু’দশক ধরে। ১৯৮০ সালে বারী সিদ্দিকী পেশাগতভাবে বাঁশি বাজানো শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম বিটিভিতে ‘সৃজন’ অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজান। ১৯৯৯ সালে ফ্রান্সে ওয়ার্ল্ড ফ্লুট সম্মেলনে এই উপমহাদেশ থেকে তিনিই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার পর দেশের বাইরে বংশীবাদক হিসেবে তার সফর কমে যায়। কণ্ঠশিল্পী হিসেবেই তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন।
বারী সিদ্দিকীর বাবার নাম মহরম আলী ও মা জহুর-উন-নিসা। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে বারী সিদ্দিকীই ছিলেন সবার ছোট। ১৯৮৬ সালে তিনি ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের সংসারে একটি কন্যা ও দুইটি ছেলে রয়েছে।
২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বর রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে যেখানে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ২৪ নভেম্বর তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানে মৃত্যুবরণ করেন।