আজম খান

বাংলাদেশের পপ গুরু খ্যাত আজম খানের পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান, ১৯৫০ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি আজিমপুরে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান, মা জোবেদা খাতুন। সেখানে তারা ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন। তার বাবা ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট। ব্যক্তিগতভাবে হোমিওপ্যাথির চিকৎসক ছিলেন। তার তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড় ভাই সাইদ খান সরকারি চাকুরিজীবী, মেজো ভাই আলম খান একজন সুরকার, ছোট ভাই লিয়াকত আলী খান সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং একমাত্র বোন শামীমা আক্তার খানম।

১৯৫৫ সালে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে ভর্তি করানো হয় আজম খানকে। ১৯৫৬ সালে তার বাবা কমলাপুরে বাড়ি বানান। এরপর থেকে সেখানে বসতি তাদের। তাই কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলেপ্রাইমারিতে এসে ভর্তি হন তিনি। তারপর ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজথেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধের পর পড়ালেখায় আর অগ্রসর হতে পারেননি।

১৯৬৯সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আজম খান পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তখন তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীরসক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসঙ্গীতপ্রচার করেন। ১৯৭১ সালে আজম খানের বাবা আফতাব উদ্দিন খান সচিবালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন। বাবার অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন তিনি । যুদ্ধ শুরু হলে, তিনি পায়ে হেঁটে আগরতলা চলে যান। আগরতলার পথে সঙ্গী হন তার দুই বন্ধু। এসময় তার লক্ষ্য ছিল সেক্টর ২ এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করা। আজম খান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ২১ বছর বয়সে। তার গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ যোগাতো। তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের মেলাঘরের শিবিরে। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সমুখ সমরে অংশ নেয়া শুরু করেন। কুমিল্লার সারদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন। এরপর তিনি ফিরে যান আগরতলায়। এরপর তাকে পাঠানো হয় ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিতে। আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইন-চার্জ, সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্ণেল খালেদ মোশাররফ। ঢাকায় তিনি সেকশন কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ি- গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তার নেতৃত্বে সংঘটিত ‘অপারেশান তিতাস’। তাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার মাধ্যমে বিশেষ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, হোটেল পূর্বাণী ইত্যাদির গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো। তাদের লক্ষ্য ছিল, হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা যাতে বুঝতে পারে, দেশে যুদ্ধ চলছে। এই অপারেশনে তিনি বাম কানে আঘাত পান। পরবর্তীতে এই আঘাত তার শ্রবণক্ষমতায় বিঘ্ন ঘটায়। আজম খান তার সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এর আগে তারা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংগঠিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করেন।

১৯৭৫ সালের ২৩ জানুয়ারি, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান বিনুর ক্যামেরায় ধরা পরেন আজম খান এবং তার ব্যান্ড উচ্চারণের বাকি তিন সদস্য বাবু, ইশতিয়াক ও হাবলু।

 

প্রকৃতপক্ষে আজম খানের কর্মজীবনের শুরু হয় ষাটের দশকের শুরুতে। ১৯৭১ সালের পর তার ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’ এবং আখন্দ ( লাকী আখন্দ ও হ্যাপী আখন্দ) ভাতৃদ্বয় দেশব্যাপী সঙ্গীতের জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেক ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকাল করে করলেন অনুষ্ঠান। ১৯৭২ সালে বিটিভিতে ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ এবং ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দু’টি প্রচার হলো প্রচার হলে তুমুল প্রশংসা ও জনপ্রিয়তা পান আজম খান, দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়ে গেলো তাদের দল। ১৯৭৪-১৯৭৫ সালের দিকে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাংলাদেশ (রেললাইনের ঐ বস্তিতে) শিরোনামের গান গেয়ে হৈ-চৈ ফেলে দেন। তার পাড়ার বন্ধু ছিলেন ফিরোজ সাঁই। পরবর্তীকালে তার মাধ্যমে পরিচিত হন ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজের সাথে। এক সাথে বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় গান করেন তারা। এরই মধ্যে আরেক বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে সৃষ্টি করেন একটি এসিড রক ঘরানার গান ‘জীবনে কিছু পাবোনা এ হে হে!’ আজম খানের দাবী, এটি বাংলা গানের ইতিহাসে প্রথম হার্ডরক।

তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আমি যারে চাইরে’, ‘রেল লাইনের ওই বস্তিতে’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘অ্যাকসিডেন্ট’, ‘অনামিকা’, ‘অভিমানী’, ‘আসি আসি বলে’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘পাপড়ি’, ‘বাঁধা দিও না’, ‘যে মেয়ে চোখে দেখে না’ ইত্যাদি।

১৯৮৬ সালে ‘কালা বাউল’ শিরোনামের একটি নাটকে কালা বাউলের চরিত্রে এবং ২০০৩ সালে শাহীন-সুমন পরিচালিত ‘গডফাদার’ চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। ২০০৩ সালে ক্রাউন এনার্জি ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রথম বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হন। এরপর ২০০৫ ও ২০০৮ সালে বাংলালিংক এবং ২০১০ সালে কোবরা ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনের মডেল হন।

খেলাধুলায়ও ব্যাপক আগ্রহ ছিলো আজম খানের। ক্রিকেটার হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন এ পপ তারকা। গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন। ৯ বছরে অনেকগুলো ক্রিকেট ম্যাচে নিজের খেলোয়ার প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন আজম খান। দেশে-বিদেশে অনেক চিকিৎসাও তাকে ফেরাতে ব্যর্থ হয়। অসাধারণ প্রতিভা ও দৃপ্ত কণ্ঠের এক সংগীত জাদুকরের জীবন থেমে যায় ৬১ বছর বয়সে। দীর্ঘদিন দূরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধির সাথে লড়াই করে ২০১১ সালের ৫ জুন রোববার সকাল ১০টা বেজে ২০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজম খান নেই, আছে তার সাড়া জাগানো জনপ্রিয় সব গান। চর্চা, অনুসারী ও গানের মধ্য দিয়েই পপসম্রাট অমর হয়ে থাকবেন।

 

উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র

ব্যক্তিগত তথ্যাবলি

পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান
ডাকনাম আজম খান
জন্ম তারিখ ফেব্রুয়ারি ২৮, ১৯৫০
মৃত্যু তারিখ জুন ৫, ২০১১
জন্মস্থান আজিমপুর কলোনি, ঢাকা
ভাই-বোন আলম খান