মোটেও নাক শিঁটকিয়ে শিরোনামটা করিনি। যৌথ প্রযোজনার সিনেমার সংখ্যা এই দেশে বা ভারতে কোন ভাবেই কম নয়।কিন্তু সত্তরের দশকে যেভাবে কেবল মাত্র বাংলা সিনেমা এক চেটিয়া হল দখল করে থাকতো আজ তা অনেক খানিই বদলে গেছে।সত্যি কথা বলতে কি ,মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা সিনেমা হল গুলো চলছে কেবল যৌথ সিনেমার বদৌলতে।
রোযার ঈদের এক মাস আগে যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত গৌতম ঘোষের শংখচিল নিয়ে অনেক আশার কথা লিখেছিলাম, কারণ ওই ছবিতে হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে যে স্বচ্ছ প্রাচীর তুলে দেওয়া হয়েছে দেশ বিভাজনের নামে-তার একটা সুব্দর গল্প ছিল।আরো ছিল সন্তানের প্রতি বাবা এবং মায়ের অসাধারণ আত্মত্যাগের ইতিহাস।এমন চমৎকার গল্প যা দুটো দেশকে সমান ভাবে উপস্থাপন করে এবং দুই দেশের শিল্পীদের কারিগরি এবং অভিনয়ের মূল্য দিয়ে থাকে সেই সমস্ত সিনেমা অবশ্যই বাহবা পাওয়ার যোগ্য।
স্কুল শিক্ষক প্রসেনজিৎ চট্টোপাথ্যায়ের পাশে মধ্যবিত্ত ঘরের গৃহিনী হিসেবে কুসুম শিকদারকে সমান ভাবে এই ছবিতে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।সংলাপের মধ্যে ভারতীয় টান ছিল না ভারতীয় শিল্পীদের মুখে(বাংলাদেশের চিত্রায়নে)।ডিজাইন,পোশাক ,এমন কি গান সব কিছুর সাথে বাংলাদেশের সংস্মৃতির ছাপ ছিল স্পষ্ট যা সত্যি প্রশংসনীয়।
কিন্তু,যৌথ সিনেমা কেবলি যদি নাম মাত্র যৌথ হয় আর দর্শক কেবল ভারতীয় স্টার দেখার জন্য হলমুখী হয় তখন প্রশ্ন ওঠে দেশের শিল্পীদের নিয়ে।সম্প্রতি একই দিনে বাংলাদেশের কিং খানের তিন তিনটে সিনেমা পু্রো বাংলাদেশের অনেক গুলো হলে মুক্তি পেয়েছে।সংবাদ মাধ্যমের খাতিরে জানতে পারলাম সাকিব খান,মৌসুমী হামিদ এবং তিশা অভিনীত মেন্টাল সিনেমার নাম বদলে বেশীর ভাগ হলে সিনেমাটি মুক্তি দেওয়া হয়েছে।স্বভাবতই আশা জাগে এই ছবির সেল অন্য দুটো সিনেমার চাইতে বেশি থাকবে।বাস্তবতা কিন্তু তা বলেনি।এই তিন দিনে এ পর্যন্ত শিকারীর সেল এতো বেশি হয়েছে যে বাকী দুটো তার কাছাকাছি যেতে হলে আরো দু’সপ্তাহ হলে রাখতে হবে এবং শিকারী বন্ধ রাখতে হবে এক সপ্তাহ।
মেন্টাল প্রসংগ বাদ দিয়ে যে দুটো ছবি পাশাপাশি বসিয়ে হিসেব করা অনেক সহজ সে দুটো হচ্ছে যথাক্রমে সম্রাট এবং শিকারী।দুটো সিনেমার হিরো হিরোইন থেকে আরম্ভ করে ক্যামেরার পেছনে যারা কাজ করেছেন তারা দীর্ঘ দিন ধরে এই সিনেমার লাইনেই আছেন। মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের পরিচালনায়-সম্রাট মুক্তি পেয়েছে ৭৫ টি হলে ।আর জয়দেব এবং সীমান্তের যৌথ পরিচালনার সিনেমা-শিকারী মুক্তি পেয়েছে ৯৮ টি হলে।
এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যৌথ প্রযোজনার সিনে্মা হলে তুলতে একটুও ভয় লাগেনি হল মালিকদের।তারা জানতেন শিকারী ভালোই যাবে ।কিন্তু প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে অন্য জায়গায়।
দুটো সিনেমার প্রধান চরিত্রেই আছেন আমাদের কিং খান -সাকিব খান।বেশি হলে মুক্তি পেলে বেশি দর্শক দেখতে পারবে সেটাই স্বাভাবিক।কিন্তু একই হলে পাশাপাশি দুটো সিনেমা চলছে ,কিন্তু দর্শকের লাইন কেবল শিকারীতে বেড়ে চলেছে সে দৃশ্য দেখে জানতে ইচ্ছে করলো কি আছে এই একই ঘরানার বাণিজ্যিক ছবিতে।
মজার বিষয় হচ্ছে শ্যামলী হলে ঈদের দিন দুপুর তিনটেয় গিয়েও সাড়ে পাঁচটার শিকারীর টিকেট পেলাম না যদিও তারা বড় করে পোস্টার করেছে “শিকারি”।এমন ভুল বানানের শিকার আমি ধরতে পারিনি। গেলাম বসুন্ধরায় ওখানেও একই চিত্র, কিন্তু অল্পসময়ের মধ্যেই পেয়ে গেলাম -সম্রাট(King is here)।
আচ্ছা কিং -তো শিকারীতেও আছে ?তাহলে সেই টিকিট পেতে আমার দু’দিন লেগে গেল কেন?এই ঘটনা কেবল আমার মতোন সাধারণ দর্শকের না।সমানে বুকিং চলছে,শিকার ধরছে শিকারী ।বুঝতে আর বাকী থাকলো না,কেবল যৌথ প্রযোজনার কারিগরি নয়,সাথে বোনাস হিসেবে আছে শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়-শিকারীতে।যে জাতি সারাদিন ঘরে বসে স্টার জলসা আর টরেন্টো থেকে ইন্ডিয়ান সিনেমা নামায় তারা কোন দুঃখে টাকা খরচ করে অপু বিশ্বাসকে দেখতে হলে যাবে?(শ্যামিলী বাড়ির কাছে বলেই ওটায় আগে যাওয়া।)
জাজ মাল্টিমিডিয়া জানে সিনেমার মাঠে কখোন কোন টিমকে নামাতে হয়।তাই ঈদের মাঠে কিং খান নয় ,খুব ভালো খেলছে ভারতীয় নায়িকা।যৌথ না গৌণ -তা নিয়ে এদেশের দর্শকের কোনই মাথা ব্যথা নেই,হলে গিয়ে পুরো আস্ত বিনোদন তাদের চা—ই চাই।ভারতের ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত খুব দূর্দান্ত অভিনয় করেছেন পুলিশ চরিত্রে সম্রাট সিনেমায়।এখন দর্শক যদি সেটা নাই দেখে তাহলে এই দেশের পরিচালক একাই যে ভালো সিনেমা বানাতে পারছেন তাও আবার বিদেশী অভিনেতা নিয়ে সেই বিষয়টি তারা কিভাবে বুঝবেন।
কেউ হয়তো ভেবেই নিলেন,আমি শিকারী সিনেমার বদনাম করতে বসেছি।বিষয়টি মোটেও তা নয় ,আমাদের দেশের শিল্পীদের কাজের মূল্যায়ণ যদি আমরাই করতে না পারি তাহলে কিভাবে চলচ্চিত্র শিল্প তার হারানো জায়গায় ফিরে যাবে।শ্রাবন্তী বা ইন্দ্রনীল নন, দর্শক হিসেবে সত্যি আশা করবো-সবাই বাংলাদেশের সিনেমা দেখতে সিনেমা হলে যাক।কৌশলগত অনেক বিষয় থাকবেই বাণিজ্যে ,তার মাঝে যদি নিজস্ব চিন্তা ধারাকে বিকিয়ে দিতে হয় এর চাইতে বড় পরাজয় আর নেই।