বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ‘ফার্স্ট লেডি’ হিসেবে খ্যাত অভিনেত্রী সুমিতা দেবী। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে তিনি বেতার, টেলিভিশন এবং মঞ্চ নাটকেও সমান তালে অভিনয় করেছেন।
তার মূল নাম হেনা ভট্টাচার্য। তিনি ১৯৩৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৪ সালে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। সে সময় বাংলাবাজার গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কারণে ১৯৫১ সালে তারা কলকাতায় চলে যান। কিছুদিন বর্ধমানেও ছিলেন। এরপর কলকাতায় ফিরে এলে বিয়ে হয় অমূল্য লাহিড়ির সঙ্গে। হেনা থেকে হয়ে গেলেন হেনা লাহিড়ি। তবে এ বিয়ে বেশিদিন টিকেনি।
১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় ছবি নির্মাণ হচ্ছে শুনে তার ইচ্ছে জাগে অভিনয়ের। এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’য় তার নায়িকা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা থাকার কারণে ওই ছবিতে তার অভিনয় করা হয়নি। প্রথম ছবি ‘আসিয়া’র পরিচালক ফতেহ লোহানী নাম পাল্টিয়ে সুমিতা দেবী রাখেন। এই ছবির আগেই সুমিতা অভিনীত ‘আকাশ আর মাটি’ (১৯৫৯) এবং ‘এ দেশ তোমার আমার’ মুক্তি পেয়েছিল। ‘আসিয়া’ ছবিতে সুমিতা ছিলেন নাম ভূমিকায়। বাংলা ছবি ছাড়াও তিনি বেশ কিছু ব্যবসাসফল উর্দু ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৬৮ সাল থেকে মা, খালা ও ভাবীর চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। ১৯৭১ সালে কলকাতায় থাকাকালে উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘শ্রী শ্রী সত্য শাহী বাবা’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেন। ৮০ ভাগ শুটিংয়ের পর ছবিটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন সুমিতা দেবী।
তিনি পঞ্চাশটির মতো ছবিতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আরও রয়েছে—‘সোনার কাজল’, ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘এই তো জীবন’, ‘দুই দিগন্ত’, ‘জনম জনম কি পিয়াসি’, ‘সঙ্গম’, ‘অশান্ত প্রেম’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘কখনো আসেনি’, ‘এই তো জীবন’, ‘বেহুলা’, ‘অভিশাপ’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘আমার জন্মভূমি’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘সুজন সখী’ ও ‘চিত্রা নদীর পারে’। ২০০০ সালে তিনি আশিক মোস্তফা পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ফুলকুমার’ ছবিতে সর্বশেষ অভিনয় করেছিলেন।
সুমিতা দেবী ৫টি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন। সেগুলো হলো- আগুন নিয়ে খেলা, মোমের আলো, মায়ার সংসার, আদর্শ ছাপাখানা ও নতুন প্রভাত।
সুমিতা দেবী অনেক সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পাকিস্তানের সমালোচক পুরস্কার (১৯৬২), ‘কাঁচের দেয়াল’ ছবির জন্য নিগার পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, বাংলাদেশ টেলিভিশন রিপোর্টার সমিতি পুরস্কার, আগরতলা মুক্তিযোদ্ধা পুরস্কার (২০০২), জনকণ্ঠ গুণীজন ও প্রতিভা সম্মাননা (২০০২) এবং চলচ্চিত্রম ফিল্ম সোসাইটি পুরস্কার।
১৯৬১ সালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম পথিকৃৎ ও প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবি জহির রায়হানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ে পরবর্তী তার নাম রাখা হয় নিলুফার বেগম। তবে তিনি সুমিতা দেবী নামেই পর্দায় কাজ করেন। তাদের সংসারে দুটি ছেলে- বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। অবশ্য পরবর্তীতে এ বিয়ে ভেঙ্গে যায়। তিনি ২০০৪ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
কৃতজ্ঞতা: ওয়াহিদ সুজন