Select Page

একজন অরুণা : আলোকিত অথচ উপেক্ষিত

একজন অরুণা : আলোকিত অথচ উপেক্ষিত

Aruna-Biswash-bangladeshi film actress‘আরণ্যক’ নামে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত একটি উপন্যাস আছে। উপন্যাসের নায়ক সত্যচরণ ভারতবর্ষের প্রকৃৃত বাস্তবতা অনুভবের জন্য জায়গায় জায়গায় ঘোরে। তো আদিবাসীদের অঞ্চলে গিয়ে তার একটা বড় অভিজ্ঞতা হল যা সে ভু্লতে পারে নি। ভানুমতী নামে একটা মেয়ের সাথে সত্যচরণের কথা বলার সুযোগ ঘটে।তাকে বলে ‘ভারতবর্ষ চেনো?’ ভানু উত্তর দেয় ‘ভারতবর্ষ কোনদিকে?’ সত্যচরণের চোখ তখন কপালে। ফেরার সময় সে অঙ্ক কষে মনে মনে নিজেকে দিয়েই।ভাবে নাগরিক লোকেরা কত যে সভ্যতা এগিয়ে যাবার বড়াই করে অথচ নিজের শেকড়ে যে বড় শূন্যস্থান আছে সেটা দেখার দরকার বোধ করে না। অারো বলা যেতে পারে ‘god must be crazy’ সিনেমার কথা। এখানেও সভ্যতা একদিকে সর্বোচ্চ শিখরের উন্নতির বড়াই করে অথচ অন্যদিকে এমনই এক জংলি সভ্যতা মিলল যেখানে বিমান থেকে পড়া সামান্য কোকের বোতল দেখে ঘাবড়ে যায় লোকজন।

বলতে চাচ্ছি শেকড়কে আগে ঠিক রাখতে হয় তারপর যত পারেন প্রগতির কথা বলেন। আগে ৩৫ মিলিমিটারের প্রতি ঋণ স্বীকার করেন তারপর যত পারেন ডিজিটাল বড়াই নিয়ে মেতে থাকেন কিচ্ছু বলার থাকবে না আর। একজন অরুণা বিশ্বাস আমাদের সোনালি দিনের সিনেমার লিজেন্ড। তাকে নিয়ে লেখাজোকা হয় না বললেই ভালো। অথচ তাঁর সময় তিনি ক্রেজ ছিলেন। তাঁর অভিনয়, গ্ল্যামার, আবেদন তখনকার তরুণদের হৃদয়কে দোলা দিত বিশ্বাস করুন আর নাইবা করুন এটা সত্য। তাঁকে নিয়ে কথা হয় না এবং সেটা এমন পর্যায়ে আছে যে ভানুমতীর মতোই আগামী প্রজন্ম বলে বসতে পারে ‘অরুণা বিশ্বাস যেন কে?’ বললে অবাক হবার কিছু থাকবে না তবে ‘অবাক’ করতে দেয়া যাবে না। দায়টা আমাদেরই নিতে হবে সৎভাবে।তাঁকে নিয়ে কথা চালু থাক। আলোকিত একজন অরুণা-কে উপেক্ষিত রাখা যায় না আর। সেরকম একটা লক্ষ্য থেকেই গোটা কতক কথা লেখার সুযোগ হল। চলুন তবে শুনবেন ‘অরুণা কথন’..

‘ঐতিহ্য’ এমন একটি বিষয় যাকে আপনার মনে রাখতেই হবে। অরুণার শেকড় মজবুত ছিল তাই নিজের নামটাও গড়েছেন পাকাপোক্তভাবেই। মানিকগঞ্জের ঘিওর থানার জাবরা গ্রামে ১৯৬৭ তে জন্ম। বাবা এদেশের যাত্রাসস্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস এবং মা যাত্রাশিল্পীদের অগ্রণী জ্যোৎস্না বিশ্বাস। দুজনই একুশে পদকপ্রাপ্ত। অরুণা মাধ্যমিক পাশ করেন ভারতেশ্বরী হোমস থেকে ১৯৮৩তে, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক ইডেন কলেজ থেকে ১৯৮০ ও ১৯৮৭তে। ৫ বছর বয়সে নিজেদের যাত্রাদল ‘চারণিক’-এ প্রথমবার অভিনয় করেন। অভিনয়ের সাথে নাচের পারফরম্যান্সে নজর কাড়েন। ১৯৮৪তে আফজাল হোসেনের সাথে ‘এখানে জীবন’ নাটকে অভিনয় করেন। এভাবেই অভিনয়কে নিজের সাধনা হিশেবে নেন।

সিনেমায় তাঁর শুরুটাকে তিনি বড় অর্জন বলতেই পারেন নিঃসন্দেহে। নায়ক রাজ রাজ্জাক তাঁকে তাঁর পরিবারের কাছে চেয়ে নিলেন ‘চাঁপা ডাঙার বউ’ সিনেমায় ছোটবৌ এর চরিত্রায়নের জন্য। নায়করাজের অনুরোধে সঙ্গত কারণেই অরুণার মা-বাবা লুফে নেন। তারপর তো ‘চাঁপাডাঙার বউ’ একটা মাইলফলক। সে মাইলফলকের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হয়ে আছেন অরুণা।

aruna biswas in the film hangor nodi granade by chashi nazrul islamবাণিজ্যিক সিনেমার অরুণা বিশ্বাস আশির শেষ ও নব্বইয়ের অনেকটা সময় জুড়ে নিজের মতো করে প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়েছেন। তাঁর নামে মুখরোচক গালগল্প চালু আছে যে অরুণা নাকি কখনোই নায়িকা হতে পারেননি। একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা। অনেক সিনেমাতেই অরুণা নায়িকা ছিলেন। ‘শাসন, হিংসার আগুন, চরম আঘাত, পরশপাথর, বন্ধু বেঈমান, অবুঝ সন্তান, মহা সম্মেলন, গরিবের সংসার, ইনকিলাব’ এ সিনেমাগুলো হাতের কাছেই মেলে প্রমাণের জন্য। চরিত্রের গুরুত্ব থেকেই ‘হিংসার আগুন’ সিনেমায় দিতির পাশাপাশি অরুণা ছিলেন লাইমলাইটে। দিতির সন্তান হবে না জেনে যখন সোহেল চৌধুরীর বাবা শওকত অাকবর যখন বংশ রক্ষার দুশ্চিন্তায় নাওয়া খাওয়া ছেড়েছেন দিতি তখন বান্ধবী অরুণাকে কপাল পুড়িয়ে নিজের সতীন বানায়। ওদিকে হুমায়ুন ফরীদি হয়ে যায় অরুণার শত্রু। ‘শাসন’ সিনেমায় অমিত হাসানের নায়িকা অরুণার অভিনয় আর গ্ল্যামার ছিল অসাধারণ। ‘পরশপাথর’ সিনেমায় অরুণার নায়িকা চরিত্রের অভিনয় মনে রাখার মতো।

পার্শ্ব চরিত্রের অরুণা অভিনয়ে নায়িকার মতোই শক্তিশালী। ‘ত্যাগ, বেনাম বাদশা, তুমি শুধু তুমি, নিষ্ঠুর, মিস্টার মওলা, মায়ের দোয়া’ এ সিনেমাগুলো তার উদাহরণ। ‘বেনাম বাদশা’ এগিয়ে থাকবে।ইলিয়াস কাঞ্চনের বোনের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন অরুণা। ‘মিস্টার মওলা’ সিনেমায় রাজ্জাকের বোন থাকে।শেষে মারা যায়। মারা যাবার পর তার লাশের সাথে স্যাড ভার্সনের মর্মান্তিক গান আছে একটি। ‘নিষ্ঠুর’ সিনেমাতে জসিমের সিনেমায় অভিনয় এবং নায়ক হয়ে ওঠার পথে আশীর্বাদ হয়ে আসেন অরুণা। বিশেষ করে ত্রিভুজ প্রেমের গল্পে ব্যর্থ প্রেমিক হিশেবে বাপ্পারাজকে যেমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলা হয় তেমনি অরুণাও ব্যর্থ প্রেমিকার চরিত্রে অনবদ্য।

এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমাতেও কাজ করেছেন অরুণা। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমার বুড়ি চরিত্র সুচরিতার সই থাকে অরুণা।বোষ্টমী অরুণা এ সিনেমায় একটা চেতনার নাম। সঙ্গীকে মুক্তিযুদ্ধে হারানোর পরে তার আর্তনাদ অসাধারণভাবে বলে সুচরিতার কাছে ‘মাইনে নেয়নি ওদের কথা। চিৎকার কইরে বইলেছিল স্বাধীনতা চাই। ‘শেষের দিকে ঝড়ের রাতে সুচরিতার বাড়িতে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময়। ঘরে ঢুকেই ভাত খেতে চায়। ক্ষুধার জ্বালাটা তাঁর ভাত খাওয়ার অভিনয়ে জীবন্ত হয়ে ধরা পড়ে। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ অরুণার জন্য আর একটি মাইলফলক। ‘চাঁপাডাঙার বউ’ এক্সপেরিমেন্টের মধ্যেই পড়ে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধায়ের গল্প থেকে জীবনমুখী সিনেমা। ছোটবৌ চরিত্রে বাপ্পারাজের বিপরীতে অনবদ্য অভিনয় ছিল অরুণার। শাবানার মতো লিজেন্ডের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অভিনয় করে নায়করাজের আস্থার প্রতিদান দিয়েছে। সামনে তাঁর আরো দুটি এক্সপেরিমেন্টাল কাজ অাসছে। ‘রাত্রির যাত্রী’ ও ‘যৈবতী কন্যার মন’।

মা, ভাবী, পুত্রবধূ এ ধরনের প্রয়োজনীয় চরিত্রগুলোতেও নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন ‘চাচ্চু, দাদীমা’ সিনেমাতে। খলনায়িকা ছিলেন গতবছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অন্তরঙ্গ’ সিনেমায়।

গানের অরুণা স্মরণীয়।মনে রাখার বা স্মৃতিতে ভাসবার মতো গান তাঁরও আছে ..
* শিকল ভাঙার গান গেয়ে যা
দেশের গান, চেতনার গান।’হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমার বোষ্টমী অরুণা পল্লী বাংলার পথে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল পরিস্থিতিতে এ গানটি গেয়ে যান একতারা হাতে।
* বলোনা কোথায় ছিলে একাকী আমায় ফেলে
স্কুলের দিনগুলোতে এ গান রেডিওতে প্রায় প্রতিদিন বাজাত।’অনুরোধের আসর গানের ডালি’ অনুষ্ঠানটিতে শ্রোতাদের অন্যতম পছন্দ ছিল গানটি।
* আমার হৃদয় ভালোবাসে যারে
‘নিষ্ঠুর’ সিনেমার চমৎকার রোমান্টিক গান। জসিমের বিপরীতে। গানে পিয়ানোর সুরে সুরে অরুণার এক্সপ্রেশন অসাধারণ।
* রুবি, ও আমার জান
‘শাসন’ সিনেমার অসাধারণ স্যাড ভার্সনের গান। অমিত হাসানের মাতাল হয়ে রাস্তায় ঘোরা আর অরুণার কাতর অভিনয় গানটির প্রাণ। গানে অমিত যখন বলে ‘i love you more than i can say’ ঐ সময়টা দারুণ লাগে শুনতে।
* প্রেম চিরদিনই পাগল এমন
‘মহা সম্মেলন’ সিনেমায় সাগরের বিপরীতে এ গানটি শ্রোতাপ্রিয় ছিল। গানটি শাহরুখ খান-কাজল জুটির ‘তুঝে দেখা তু ইয়ে জানা সনম’ থেকে অনুকরণ করে করা।
* এসো সবাই মিলে
‘পরশপাথর’ সিনেমার এ জীবনমুখী গানটিতে খোলা চুলে অরুণার স্যাড এক্সপ্রেশনগুলো বলে দেয় তিনি বড় শিল্পী।

একজন অরুণা বিশ্বাস দেশের সিনেমার একটি অধ্যায়। এর পরিচ্ছেদগুলো জানার চেষ্টা করে অনাগত দর্শক প্রজন্মকে জানাতে হবে। তবেই অরুণা চর্চা চালু থাকবে।আমাদের লিজেন্ডদের আলোকিত দিকগুলো লুকিয়ে উপেক্ষা করলে দুর্নামটা খোদ নিজেদেরই।

আসুন, ‘অরুণা’-দের মতো আরো যারা আছেন তাঁদের জানার চেষ্টাটা করি। ‘অকৃতজ্ঞ’ জাতির বদনামটা ঘোচাতে শুরু করি সমবেত সাধনা।


মন্তব্য করুন