মুক্তির অনেক আগে থেকেই অগ্নি টু আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। চলচ্চিত্রটির বিশাল বাজেট, গতবছরের অগ্নির ব্যবসায়িক সাফল্য, দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনা, মাহিয়া মাহীর সিনেমা ছাড়ার নানান জল্পনা কল্পনা, জাজ মাল্টিমিডিয়ার সাথে মাহীর সম্পর্কের টানাপোড়েন এসব কিছু অগ্নি টু’র প্রতি একটি বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি করে।
অগ্নি টু যৌথ প্রযোজনার সিনেমা। বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়া ও ভারতের এসকে ফিল্মস ছবিটি প্রযোজনা করেছেন, তাই প্রথমেই আমার নজর ছিল আসলে কতটুকু যৌথ ছবি এটা সেটা দেখার। ছবির টাইটেল গুলো খেয়াল করছিলাম। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ অবদান রয়েছে। চিত্রগ্রহন, সম্পাদনা, চিত্রনাট্য, সঙ্গীত প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং ভারতের শিল্পীদের যৌথ নাম লক্ষণীয়। ফলে এটা মনে হয়েছে যে সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত যৌথ প্রযোজনার সিনেমাগুলোর মধ্যে আক্ষরিক অর্থে দুই বাংলার সিনেমা হিসেবে অগ্নি টু সিনেমাটিই সবচেয়ে যথাযথ। অন্তত পক্ষে ছবিটির টাইটেল গুলো দেখে তাই মনে হয়েছে।
অগ্নি নামের অপ্রতিরোধ্য মেয়েটির প্রতিশোধের গল্প ছিল অগ্নি, অগ্নি টু চলচ্চিত্রটিও এর ব্যতিক্রম নয়। একটি পুরোদস্তুর নায়িকা প্রধান প্রতিশোধের গল্প অগ্নি টু। গল্পের ক্লাইম্যাক্সে অপ্রত্যাশিত কোন বিষয় নেই। কাহিনীর মূল খলচরিত্রটির মুখোশ উন্মোচন তথা অগ্নির প্রতিশোধ পরিপূর্ণ হবে কিনা বা কেমন করে হবে তা জানতে দর্শককে সিনেমাটির শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না, খুবই প্রত্যাশিত এবং গতানুগতিক চিত্রনাট্য সিনেমাটির।
সংলাপগুলো দূর্বল এবং গতানুগতিক। নায়িকা মাহীর চরিত্রের গঠন অনুযায়ী তার সংলাপ এমনকি খলচরিত্রে রুপদানকারী আশিস বিদ্যার্থীর চরিত্রের ক্ষমতা অনুযায়ী তার সংলাপ যথাযথ মনে হয়নি। সংলাপগুলো আরও ওজনদার হতে পারতো। গল্পে নায়ক ওমের সাথে নায়িকা অগ্নির প্রেম শুধুমাত্র গানগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। একটি সিকোয়েন্স রয়েছে যেখানে কেন জানি মনে হয় পরিচালক নায়ক নায়িকার প্রেমের আবহ তৈরী করতে তাদের এক প্রকার জোর করেই একটি জনহীন দ্বীপে নিয়ে যান। দ্বীপের দৃশ্য গুলো ভিস্যুয়ালি নান্দনিক হলেও গল্পের সাথে তার কোন যোগসূত্র পাওয়া যায় না।
অগ্নির ক্ষেত্রে যেমন মোটা দাগের কিছু ভুল চোখে পড়েছিল যেমন নায়ক আরিফিন শুভর মা থাই বলা হলেও তার একমাত্র মামা ছিলেন বাঙ্গালি এরকম বড় ভুল অগ্নি টু তে নেই। তবে ভাষাগত ভুল রয়েছে, যেমন থাইল্যান্ডের বাঙ্গালি পুলিশ অফিসার অমিত হাসান অনর্গল বাংলায় তার থাই পুলিশ অফিসারদের নির্দেশনা দিয়ে গেলেও অবাঙ্গালি থাইল্যান্ডবাসী পুলিশেরা কি করে তা বুঝেন তা আমার বুঝার বাহিরে, কিংবা দক্ষিণ ভারতীয় পরিচয় দেওয়া এক খলচরিত্র শুধুমাত্র তামিল তেলেগু ভাষার টানটা বজায় রেখে বাকিটা অনর্গল শুদ্ধ বাংলা কিভাবে বলে যান সেটাও বোঝা কষ্টকর।
যে কোন প্রতিশোধের গল্প নির্ভর চলচ্চিত্রে শেয়ানে শেয়ানে টক্কর হতে হয় অর্থাত্ নায়ক বা নায়িকা যতটা শুভ শক্তিতে শক্তিশালী ঠিক ততটা না হলেও কাছাকাছি পর্যায়ের শক্তিশালী হতে হয় খলচরিত্রটিকে। যদিও ছবি শেষে শুভ শক্তিরই জয় হয়। তাহলে চলচ্চিত্রটি অনেক বেশী উপভোগ্য হয়ে উঠে। অগ্নি টু সিনেমাটির নায়িকা একচেটিয়াভাবে এতোটাই শক্তিশালী যে তার বিরুদ্ধ চরিত্রগুলোকে খুবই নগন্য মনে হয় ফলে সিনেমাটি একঘেয়ে মনে হয়। ছবিটিতে পরিচালক ইফতেখার চৌধুরী আশিস বিদ্যার্থীর মত অত্যন্ত শক্তিশালী একজন নেগেটিভ চরিত্রের অভিনেতাকে নিয়েছেন বটে কিন্তু চিত্রনাট্যটিই এমনভাবে তৈরী যে আশিস বিদ্যার্থী তার শতভাগ দিতে পারেননি। মাহীর অগ্নি চরিত্রটি শক্তিশালী করতে গিয়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলো কেমন জানি নির্জীব মনে হয়। সিনেমাটিতে প্রথমার্ধে গতি ছিল, ডিটেইলিংটাও মোটামুটি ভালো ছিল, স্ক্রীপ্ট অনুযায়ী অত্যন্ত দক্ষ ও সুনিপুন নির্মাণ ছিল কিন্তু গল্পে যদি আরও কিছু সংকট, সমস্যা, ঘাত-প্রতিঘাত বা বাঁধা থাকতো তাহলে সিনেমাটি আরও উপভোগ্য হোত তা না হয়ে সিনেমাটি হয়ে গিয়েছে অনেকটা স্বাদহীন চিত্রনাট্যের মশলাদার নির্মাণ।
অগ্নি টু এর বেশ কিছু দিক প্রশংসনীয়। সুন্দর লোকেশন, ভালো সিনেম্যাটোগ্রাফি, গ্ল্যামারাস পোশাক পরিকল্পনা, নাচ ও গানগুলো দৃষ্টিনন্দন ও শ্রুতিমধুর। ইমন সাহার আবহ সঙ্গীতও বেশ মানানসই। অভিনয় প্রসঙ্গে সবার প্রথম মাহিয়া মাহীর কথা বলতে হয়, তিনি তার প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রে উন্নতি করছেন। অগ্নির তুলনায় অগ্নি ২ তে তার অভিনয় যথেষ্ঠ ভালো বিশেষ করে মারামারির দৃশ্যগুলো অনবদ্য। মারামারির সিকোয়েন্স গুলোই এই সিনেমাটির প্রাণ। এর আগে বাংলাদেশের কোন অভিনেত্রীকে এরকম কৌশুলি ও দৃষ্টিনন্দন মারামারির সিকোয়েন্স করতে দেখা যায়নি এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। নায়ক ওমের যতটুকু অভিনয়ের সুযোগ ছিল তিনি করেছেন, তবে মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে তিনি কিছুটা আন্ডার এক্সপ্রেসিভ। ভারতের দুজন খুব ভালো অভিনেতা ছিলেন ছবিটিতে প্রধান নেগেটিভ চরিত্রে আশিস বিদ্যার্থী ও কিছুটা কমেডিয়ানের চরিত্রে খরাজ মুখার্জি তারা তাদের অভিনয়ে সিদ্ধহস্ত তবে পরিচালক তাদের কাছ থেকে শতভাগ আদায় করতে পারেননি।
চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে ইফতেখার চৌধুরী তার প্রত্যেকটি সিনেমাতে উন্নতি করছেন নিঃসন্দেহে। আমার কাছে মনে হয় বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা নির্মাণে তিনি এ দেশীয় অন্যান্য অনেক নির্মাতার চেয়ে অনেক বেশী আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন একজন নির্মাতা এবং তিনি তা যথাযথ প্রয়োগও করতে পারেন, অগ্নি টু তার একটি উদাহরণ। একটি গতানুগতিক গড়পরতা চিত্রনাট্যের তিনি একটি সুনিপুণ cinematic structure দাঁড় করিয়েছেন। তবে তার নির্মাণ সঙ্গী হিসেবে চিত্রনাট্যকার বা গল্পকার তার সঠিক সহযোগী হতে পারেননি। তাই ভালো গল্প, চিত্রনাট্য এবং ভালো বাজেট পেলে ইফতেখার চৌধুরী আমাদের আরও ভালো বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র উপহার দিতে পারবেন বলে আমার মনে হয়। সেই মেধা ও দক্ষতা তার রয়েছে। ঘোষনা এসেছে অগ্নি থ্রি নির্মাণের, আশা করব ইফতেকার চৌধুরী এবার গল্প ও চিত্রনাট্যের প্রতি একটু মনোযোগী হবেন।