নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র, প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। এই সিনেমাটির সব চরিত্র, ঘটনা এবং গল্পের পারিপার্শ্বিক সবকিছুতেই নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্রের প্রমাণ মেলে। আমাদের বাস্তব জীবনেও তো সব ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পঞ্চম ছবি পিঁপড়াবিদ্যা যেন তাই আমাদের জীবনেরই গল্প।সরয়ার ফারুকী তার প্রত্যেকটি নতুন সিনেমায় তার পূর্ববর্তী সিনেমার চেয়ে বেশী চিন্তার খোরাক রাখছেন। তার আগের চারটি ছবি যদি বিশ্লেষণ করেন তাহলে দেখতে পাবেন প্রত্যেকটি ছবি তার পূর্ববর্তী ছবির তুলনায় অনেক বেশী ভাবায়, প্রত্যেকটি ছবি আগের ছবির তুলনায় অনেক প্রাপ্তবয়স্ক। পিঁপড়াবিদ্যা এই তালিকায় সবচেয়ে সাম্প্রতিক সংযোজন।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন,”পিঁপড়াবিদ্যা এমন একটি ছবি যা দেখে প্রত্যেকটি দর্শক নতুন নতুন ছবির গল্প তৈরী করবে”। পিঁপড়াবিদ্যায় এমন কিছু দৃশ্য রয়েছে আপনি যদি মনে করেন তাহলে সেগুলোর একেকটি নিয়ে বন্ধুদের সাথে একেকটি ঘণ্টা খানেকের টক শো করে ফেলতে পারবেন। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি একটি দৃশ্যে দেখা যায় সমুদ্রের ঢেউ এসে যখন চলে যায় তখন তীরে বালুর উপর অনেক গুলো ছোট ছোট মানুষের কৃত্রিম মুখাবয়ব পরে থাকে, একই রকম দেখতে কিন্তু অনেক গুলো। দর্শক হিসেবে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন এ দৃশ্য। মনে করুন ঢেউ যেন সময়, আর সে যায় আর আসে, সময়ের সাথে সাথে একই মানুষের অনেকগুলো চেহারা ফুটে ওঠে, সময়ের সাথে সাথে মানুষ কখনও অসহায়, ভীত আবার কখনও ভালো কখনও খারাপ কখনও বা দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। পিঁপড়াবিদ্যার সবগুলো চরিত্রও চেহারা পাল্টায় যখন সময় যেরকম বলে তখন সেরকম রূপ নেয়। সমুদ্রের তীরেই নায়িকা এক স্বপ্নিল পোষাকে আর তার পাশে একটা উঁচু টেবিল, নায়ক দৌড়ে উঠে যায় সেই টেবিলের একেবারে উপরে, একেবারে নায়িকার মাথার উপরে।বসে বসে খেতে থাকে নায়িকার মাথার পিঁপড়া। এ পিঁপড়া মানুষের দুর্বলতার পিঁপড়া, মানুষের মাথায় কিলবিল করতে থাকা নানান রকম চিন্তা চেতনার পিঁপড়া, মানুষ নিয়ন্ত্রণের মোক্ষম বিদ্যা এই পিঁপড়া। পরের দৃশ্যেই দেখা যায় সমুদ্রে তীরে পরে থাকা নায়কের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসছে সেই পিঁপড়া, নায়ক আর সহ্য করে উঠতে পারেনা এই পিঁপড়াবিদ্যা ঝাঁপিয়ে পরে সমুদ্রে। সবল মানুষের দুর্বলতায় দুর্বল পিপীলিকারও পাখা গজিয়ে যায়, দুর্বল পিঁপড়াও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সবলকে। কিন্তু সে ভুলে যায় দুর্বলতা তারও থাকতে পারে। দৃশ্যটি সম্পূর্ণ রূপক তবে সমাজে এর প্রতিফলন হয় নিয়মিত। এরকম আরও অনেক দৃশ্য রয়েছে যেগুলো দর্শক হিসেবে আপনাকে ভাবাবে আপনার দ্বারা গল্প তৈরী করাবে।
পিঁপড়াবিদ্যা কোন এক শ্রেণীর মানুষের গল্প নয়, সমাজের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের গল্প। ইট কাঠ পাথরে আবদ্ধ নাগরিক জীবন যুদ্ধের গল্প পিঁপড়াবিদ্যা, পিঁপড়ার মত মানুষদের উড়বার স্বপ্নের গল্প পিঁপড়াবিদ্যা। মানুষের লোভ, লালসা, ভয়, সাহস, অসহায়ত্ব, সংগ্রাম, ছলচাতুরী, মানুষের খারাপগুণ, ভালোগুণ এ সবকিছুকে নিয়ে পিঁপড়াবিদ্যা। আমরা জন্মগ্রহণ করি তারপর বড় হতে থাকি, জীবনের নানান ঘাতপ্রতিঘাতে, নানান রকম সময়ে আমরা ঠেকি তারপর শিখি, খারাপ কিছু শিখি আবার ভালো কিছু শিখতে চাই কিন্তু লোভ আসে হিংসা আসে আমরা গা ভাসায় লোভের দিকে। এসব বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি পিঁপড়াবিদ্যা। সিনেমার গল্পে দেখানো হয়েছে জীবনটা একরকম অভিনয়, নানান রকম চরিত্রে অভিনয় করি আমরা।যখন যেটাতে ভালো লাগে সে চরিত্রে ঢুকে পরি, আবার অনেক সময় ভালো না লাগলেও ঢুকে পরতে হয় কোন এক চরিত্রে। এক চরিত্র থেকে আরেক চরিত্রে যেতে যেতে একসময় ক্লান্ত হই থিতু হই আসল রূপে আসি কিন্তু ততদিনে আর কেউ বিশ্বাস করার থাকেনা আমাদের।
ছবিটি open ended, ফারুকীর থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ছবিটিও open ended ছিল, অর্থাৎ শেষ হয়েও হলনা শেষ। এ ধরনের সিনেমায় শেষটা কি রকম হবে সেটা পরিচালক দর্শকদের উপর ছেড়ে দেন, বিভিন্ন দর্শক তাদের চিন্তাধারা ভেদে সিনেমার বিভিন্ন রকম পরিণতি টানতে পারেন।
চিত্রগ্রহণের প্রসঙ্গে আসি, অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি। সরয়ার ফারুকীর ক্যামেরা ফ্রেমিং স্বকীয়, তিনি ছক-বাঁধা ফ্রেমিং এর নিয়মে হাঁটেন না। চরিত্রের সংলাপের চেয়ে তার অভিব্যক্তির ডিটেইলিং এ ফারুকীর ক্যামেরা ফ্রেমিং বেশী গুরুত্ব পায়। ধরুন দুজন লোক কথা বলছে, আরেকজন বা আরও অনেক লোক সেই কথা শুনছে এখন যেহেতু কথা বা সংলাপ শোনাই যাবে তাই ওটা ক্যামেরায় দেখানোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে লোকগুলো কথা শুনছে তাদের এক্সপ্রেশন ক্যামেরার ফ্রেমে আনা, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ছবিগুলোতে এ বিষয়টা লক্ষণীয় এবং বলা যেতে পারে এ ক্ষেত্রে তিনি বাংলা সিনেমায় একটা নতুন ধারা এনেছেন। পিঁপড়াবিদ্যাও এর ব্যতিক্রম ছিলনা। একটা দৃশ্য উল্লেখ না করলেই নয়, চলন্ত গাড়ির পেছনের সিটে ছবির পাত্র পাত্রী বসে অনেক ব্যক্তিগত আলাপ করছেন কিন্তু ফ্রেম জুড়ে দেখা যায় শুধু একটা কান, অর্থাৎ গাড়ির ড্রাইভারের কান, যা নায়ক নায়িকার ব্যক্তিগত কথাগুলো অনেক আগ্রহ নিয়ে শুনছে ।
সরয়ার ফারুকী ডিটেইলিং এর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সচেতন বিশেষ করে চরিত্রের অভিব্যক্তির ডিটেইলিং এ, ছবিটির গল্পের ডিটেইলিং এ কিছুটা ফাঁক ফোকর ছিল যেমন শিনা চোহানের চুরি হয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন যখন নুর ইমরান মিঠুর হাতে আসে তখন এতো দ্রুত কি ভাবে ফোন ট্র্যাক করা হল সেটার ডিটেল দেখানো হয়নি কিংবা একটা দৃশ্যে মিঠু যখন পালিয়ে একটা দোকানে আশ্রয় নিয়ে গা ঢাকা দিল, মিঠুর সাথে সেই দোকানদারের কি সম্পর্ক সেটাও স্পষ্ট নয়। তবে চরিত্রগুলোর সংলাপ ডেলিভারির সময় বা চরিত্রগুলোর যে কোন ধরনের কার্যকলাপের এক্সপ্রেশনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেলিং ছবিতে দেখানো হয়েছে। সরয়ার ফারুকীর সিনেমার সংলাপ যেরকম হয় এই ছবির বেলাতেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। অত্যন্ত সাবলীল ও পরিমিত সংলাপ, যে শ্রেণীর মানুষের মুখের বুলি যেরকম হওয়া উচিত ঠিক সেরকম ব্যবহার করা হয়েছে, নির্মাতা তার পূর্বের ছবিগুলোর তুলনায় সংলাপের ক্ষেত্রে এ ছবিতে আরও বেশী সংযত হয়েছেন। শুধু মাত্র মানুষের মুখের সাধারণ বুলি বা সাধারণ জীবনের নানান ছোট ছোট ঘটনা থেকেও যে হাস্যরস আসে পিঁপড়াবিদ্যা তার একটি উদাহরণ, কোন আরোপিত কমেডি সিকোয়েন্স ছবিতে দেওয়া হয়নি। এখানেও পরিচালক তার পূর্ববর্তী ছবিগুলোর তুলনায় অনেক সংযত থেকেছেন। সিনেমাটিতে একটি গান আছে, করেছেন ব্যান্ড চিরকুট, গল্পের সাথে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি গান। আবহসঙ্গীত করেছেন ইমন সাহা, হৃদয় খান। সিনেমাটিতে আবহসঙ্গীতের অত্যন্ত পরিমিত ব্যবহার লক্ষণীয় ।
অভিনয় প্রসঙ্গে আসি, শিনা চোহান বিপিএলের কল্যাণে বাংলাদেশে এখন বেশ পরিচিত, তিনি ছবিটিতে রীমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন, চরিত্রটি একজন অভিনেত্রীর। তিনি যথেষ্ট ভালো করেছেন, পরিমিত এবং সংযত অভিনয়। তার উপস্থাপনা করার অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে তার বেশ সহায়ক ছিল, বিশেষ করে ইংরেজি উচ্চারণে। অন্যান্য চরিত্রগুলোর মধ্যে সকলেই ভালো করেছেন, বিশেষ করে মিঠুর মায়ের চরিত্রে অভিনয়কারী যিনি তিনি বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যার অভিনয় চোখে লেগে থাকে তিনি নুর ইমরান মিঠু, পিঁপড়াবিদ্যার মূল চালিকা শক্তি, তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা তার প্রথম সিনেমা। অত্যন্ত সাবলীল আর স্বাভাবিক অভিনয়, কৃত্রিমতা বর্জিত ঝরঝরে মেদহীন অভিনয়, এক কথায় সিনেমার মিঠু চরিত্রটির সঠিক বিচার করেছেন অভিনেতা মিঠু, তার প্রতি জানাই সাধুবাদ।
কতগুলো সিনেমা হয়, যেগুলো দর্শক দেখছেন, বিনোদিত হচ্ছেন, কখনও হাসছেন কখনও বা কষ্ট পাচ্ছেন কিন্তু এ সবকিছুর সাথে সাথে দর্শকের মস্তিষ্কে কিছু একটা হতে থাকে, দর্শক ভাবেন, চিন্তা করেন আর আবিষ্কার করতে থাকেন, প্যাঁচ খুলতে থাকেন, গল্প বানাতে থাকেন। নিজের জীবনের সাথে, চরিত্রের সাথে সেই গল্প মেলাতে থাকেন, মস্তিষ্কে অনুরণন হতে থাকে, নিউরনে অনুরণন হতে থাকে। পিঁপড়াবিদ্যা সেরকম একটি সিনেমা, পিঁপড়াবিদ্যা নিউরনে অনুরণন ।