Select Page

কবরীর কথা..

কবরীর কথা..

এক.

kobori07-600x330অভিনয়ের পঞ্চাশ বছর পার করছেন অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী। তিনি মিষ্টি হাসির মেয়ে নামে পরিচিত।বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তার আলাদা স্থান রয়েছে। এটাই স্বাভাবিক যে, তার অভিনয় প্রতিভা নিয়ে খুব একটা কথা শোনা যায় না।  সাদামাটা চেহারার এমন সিগ্ধ হাসি আছেই বা কয় জনের। সেই উদাহরণে পরে আসি।

বাংলা চলচ্চিত্রের নায়িকা প্রসঙ্গে আসলে আরো দুইজনের কথা বলতে হয়। আসলে এমন হতে পারে এই দুইজনের প্রভাবে কবরীর আলাদা অবস্থানটা চোখের আড়ালেই থেকে গেছে। কিন্তু সেই বলয়ের বাইরে কবরীর সংগোপন আলাদা একটা অবস্থান ও গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে।

সেই দুই নায়িকার প্রথমজন শাবানা। এমন বিপুল সময় আর কোন নায়িকা আমাদের চলচ্চিত্র জগতে শাসন করেন নাই। কিন্তু জনপ্রিয়তার প্রশ্নে তিনি নির্দিষ্ট শ্রেণি ও ঘারাণার অন্তর্ভুক্ত। শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে তার গ্রহনযোগ্যতা সে অর্থে গড়ে উঠে নাই। কিন্তু এর বাইরে নিয়মিত বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের দর্শক একটা অংশ তার ভক্ত। অন্যদিকে সত্যজিতের ছবিতে অভিনয় করে আন্তর্জাতিক অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন ববিতা। যা এখনো রেফারেন্স আকারে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে ঘুরে ফিরে আসে। তিনি ছাড়া তাদের উপযোগী সেলিব্রেটি নাই। সে অর্থে কবরী ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৭৩)-এ অভিনয় করেও নাম কামাতে পারেন নাই। যতটা পেরেছেন তার আলাদা মেজাজের ছবিগুলোতে। ইন্টারেস্টিংলি তার বড় অংশ গ্রামীন ও ফোক ফ্যান্টাসি জেনরের। তা সত্ত্বেও চলচ্চিত্রের সব শ্রেণির দর্শকের কাছে তার আলাদা কদর। যেটা শাবানা বা ববিতার চেয়ে একদম আলাদা। সেই অভিনয় হোক অথবা হাসিই হোক।

আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তিনি বড় একটা সময় নিজেকে চলচ্চিত্র থেকে আলাদা করে রেখেছিলেন। বছরের পর বছর গতানুগতিক চেহারা দেখানো থেকে নিজেকে তিনি বিরত রাখলেন। অর্থ্যাৎ, জনপ্রিয়তার ভেতর থেকেই সুনির্দিষ্টভাবে নিজের বিদায়টা নিতে পেরেছেন। ফলে কবরী বললেই একটা সবুজ চেহারায় ভেসে উঠে। যদিও রাজনীতিবিদ হওয়ায় মিডিয়ায় তার উপস্থিতি নিয়মিত। তবে একজন চলচ্চিত্র নায়িকার জাতীয় সংসদে যাওয়া আমাদের দেশের জন্য বিরল বটে এবং শিল্পী সমাজের জন্য সম্মানের বটে। এর জন্য তাকে স্যালুট জানাতে হয়।

দুই.

কবরীকে নিয়ে একটি কথা প্রচলিত ছিল- কবরী হাসলে লাখ টাকা, কাঁদলেও লাখ টাকা। হাসির কথায় বলি, কান্না থাক। এই হাসির কতরুপ, অথচ একই মানুষ একই মুখ। নীল আকাশে নীচে (নারায়ণ ঘোষ মিতা, ১৯৬৯) ছবির ‘সারা নিশি এত সুর নিয়ে..’ গানটিতে শহুরে মেয়েটির সলজ্জ হাসি প্রথম প্রেমের প্রতিনিধিত্ব করে। সারেং বউ (আবদুল্লাহ আল মামুন, ১৯৭৮) ছবির ‘ওরে নীল দরিয়া..’ গানটির শেষ মুহুর্তের ঘুম জড়ানো হাসির কথা কি মনে আছে? মনে করে দেখুন। এমন হাসি আর কোথায় পাবেন! অথবা ‘গুন গুন গুন গান গাহিয়া’য় সুতরাং (সুভাষ দত্ত, ১৯৬৪) ছবির সরল গ্রাম্য বালিকার হাসি। এমন তার লাখ টাকার হাসি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না হাসির আড়ালে যেন তার ন্যাচারাল অভিনয় ঢাকা না পড়ে।

কবরীর অভিনয়ের চল্লিশ দশকের হাসি মেলা বসে ছিল যেন জাতীয় জাদুঘরে। সাম্প্রতিক এক প্রদর্শনীর কথা বলছি। গ্রীনভ্যালী ফাউন্ডেশন আয়োজিত সেই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়ে ছিল কবরীর দুইশটি ছবি। শেষ দিনে প্রদর্শনী দেখে বেরুতে গেছি, দেখি গ্যালারিতে ঢুকছেন কবরী। সেই হাসিতে উদ্ভাসিত তার মুখ।

তিন.

সমকাল পত্রিকা ঘেটে কবরীর আবির্ভাব জানলাম এই হরফে- ১৪ বছর বয়সে মিনা নামে একটি কিশোরী পেটে গামছা প্যাঁচানো পুঁটলি বেঁধে গর্ভবতী নারীর চরিত্রে অভিনয় করেন, সেই সূচনা। সেটি ছিল সুভাষ দত্ত পরিচালিত ও অভিনীত ‘সুতরাং’ ছবি। নায়িকা কবরীর আবির্ভাব তখনই। রীতিমতো খুঁজে বের করা হয়েছিল তাকে। গল্পটা এমন_ সুভাষ দত্ত তখনও সুভাষ দত্ত হয়ে ওঠেননি। তিনি তখন চলচ্চিত্রে পোস্টার, ব্যানার তৈরি করেন। ‘মাটির পাহাড়’ (মহিউদ্দিন, ১৯৫৯)-এর সহকারী পরিচালক সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সৈয়দ হককে তিনি নিজের একটি সুপ্ত ইচ্ছার কথা জানালেন। সুভাষ দত্তের স্বপ্ন- একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। একজন প্রযোজক তাকে ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অবশ্য তখন একটি ছবি তৈরি করতে সর্বোচ্চ ৯০ হাজার টাকা লাগতো। এ অবস্থায় সৈয়দ হক তাকে নির্ভয় দিলেন। এরই মধ্যে সত্য সাহাকে আবিষ্কার করলেন সৈয়দ হক। এবার তিনজন মিলে ছবি তৈরির প্রাথমিক কাজগুলো করতে শুরু করলেন। এর মধ্যে চিত্রনাট্য ও গানগুলো তৈরি হয়ে গেল। একজন নায়িকা দরকার যাকে সুভাষ দত্তের সঙ্গে মানাবে। (সুভাষ দত্ত নায়ক চরিত্র করছেন শুনে তখন অনেকেই হাসাহাসি করতেন। তারা ধরেই নিয়েছিলেন ছবিটি ফ্লপ করবে।) এই চিন্তা থেকে সত্য সাহা চট্টগ্রামের এক মেয়ের খোঁজ দিলেন, তার নাম মিনা। খবর পেয়ে বাবা মিনাকে নিয়ে এলেন এই তিনজনের কাছে। বেশকিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে মিনা নির্বাচিত হলেন ‘সুতরাং’ ছবির নায়িকা হিসেবে। সুভাষ দত্ত তার পর্দানাম রাখলেন কবরী।

চার.

চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীতে জন্মগ্রহন করেন মিনা পাল। পিতা শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল এবং মা শ্রীমতি লাবণ্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে আবির্ভাব কবরীর৷ ১৯৬৪ সালের ‘সুতরাং’র পর তাকে ফিরে তাকাতে হয় নাই। তিনি দেশে নির্মিত সব জেনরের প্রায় শতাধিক ছবিতেই অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে  হীরামন (প্রাচী গোষ্ঠী, ১৯৬৭), ময়নামতি (কাজী জহির, ১৯৬৯), চোরাবালি (চোরাবালি, ১৯৬৮), পারুলের সংসার (সিরাজুল ইসলাম, ১৯৬৯), বিনিময় (সুভাষ দত্ত, ১৯৭০), আগন্তুক (বাবুল চৌধুরী, ১৯৬৯), বেঈমান (রুহুল আমিন, ১৯৭৪), চেতনা (ছটকু আহমেদ, ১৯৯০), রংবাজ (জহিরুল হক, ১৯৭৩), সারেং বৌ (আবদুল্লাহ আল মামুন, ১৯৭৮), নীল আকাশের নিচে, যে আগুনে পুড়ি (আমির হোসেন, ১৯৭০), আঁকাবাঁকা (বাবুল চৌধুরী, ১৯৭০), সুজনসখী (প্রমোদকর, ১৯৭৫), মতিমহল (অশোক ঘোষ, ১৯৭৭), মাসুদ রানা (মাসুদ পারভেজ, ১৯৭৪), অবাক পৃথিবী (মোস্তফা মেহমুদ, ১৯৭৪), বধূবিদায় (কাজী জহির, ১৯৭৮), দীপ নেভে নাই (নারায়ন ঘোষ মিতা, ১৯৭০), স্মৃতিটুকু থাক (আলমগীর কুমকুম, ১৯৭১), কলমীলতা (শহীদুল হক খান, ১৯৮১), দেবদাস (চাষী নজরুল ইসলাম, ১৯৮২), নিজেরে হারায়ে খুঁজি (রুহুল আমিন, ১৯৭২), কখগঘঙ (নারায়ন ঘোষ মিতা, ১৯৭০), বাহানা (জহির রায়হান, ১৯৬৫) ও তিতাস একটি নদীর নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি আয়না নামের একটি ছবি পরিচালনাও করেছেন। অনেক পুরষ্কার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সারেং বউ-র ‘নবীতুন’ চরিত্রের জন্য ১৯৭৮ সালে তিনি পেয়েছেন সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করেছেন। যুক্ত আছেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে।

পাঁচ.

কবরী তার ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সাড়া জাগানো রোমান্টিক ছবিগুলো করেছেন রাজ্জাকের সাথে জুটি বেধে। তাদের অভিনীত উল্লেখ চলচ্চিত্র হলো- স্মৃতিটুকু থাক, আবির্ভাব, নীল আকাশের নিচে, কখগঘঙ প্রভৃতি। তাদের নিয়ে সে সময় নানা গুজব চালু ছিল। এ সম্পর্কে বিবিসি বাংলায় দেয়া সাক্ষাৎকারে কবরী বলেছেন, ‘আমরা এমন আবেগ ঢেলে অভিনয় করতাম, ছবির প্রণয় দৃশ্যগুলো হয়তো খুবই স্বাভাবিক এবং জীবন্ত হয়ে উঠতো’।

এছাড়া তিনি ফারুক ও বুলবুল আহমেদের সাথে জুটি বেধে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ফারুকের সাথে কাজ করেছেন সুজন সখী ও সারেং বউ-র মতো কালজয়ী ছবিতে। বুলবুল আহমেদের সাথে দেবদাস, বধুবিদায়, আরধনা (রাজু সিরাজ, ১৯৭৯) ও দুই জীবন (আবদুল্লাহ আল মামুন, ১৯৮৮) উল্লেখযোগ্য।

তথ্যসূত্র: দৈনিক সমকাল, বিবিসি বাংলা এবং চলচ্চিত্রের ইতিহাস- অনুপম হায়াৎ।

>আমার লেখার খাতা: ইচ্ছেশূন্য মানুষ


মন্তব্য করুন